উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ারধারণের বাধ্যবাধকতার প্রভাব পড়েছে কোম্পানির লভ্যাংশে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন অনেক কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ারধারণের সীমা বাধ্যতামূলক করতে চলতি বছর বেশ কয়েকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসি।
এর মধ্যে একটি উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ না করলে ওই কোম্পানি বোনাস শেয়ারও দিতে পারবে না। এতদিন শুধু রাইট শেয়ার দেওয়া ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল; এখন বোনাস শেয়ারও দেওয়া যাবে না।
বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, অনেক কোম্পানি আছে যাদের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার নেই কিন্তু ওইসব কোম্পানির আয় ভালো হয়েছে। এখন যদি তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ওই আয়ের বড় অংশ ব্যয় করেন তাহলে বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ কম দেবেন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বিনিয়োগকারীরা। আর এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে যদি বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেওয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে উপকৃত হত বিনিয়োগকারীরা।
তারা উদহারণ হিসেবে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানি আছে যারা ভালো আয় করেছে। গত অর্থবছরে মুনাফা দেখা কোম্পানির মধ্যে সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমটেড, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডা., ফু-ওয়াং ফুড, অগ্নি সিস্টেম লিমিটেড, বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, অ্যাকটিভ ফাইন ক্যামিকেলস লিমিটেড , সালভো কেমিক্যাল রয়েছে। এর মধ্যে অ্যাকটিভ ফাইন ক্যামিকেলস লিমিটেড ৩০ জুন ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) করেছে ২ টাকা ৯৭ পয়সা। কিন্তু ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তারা আয়ের একটি খরচ করেছে। তাই বিনিয়োগকারীদের ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যদি তারা নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি বোনাস শেয়ার দিতে পারতো তাহলে লাভবান হত বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে বিএসইসির এ আইন জারির আগে যেসব কোম্পানি বাজারে এসেছে তাদের সঙ্গে আইনটি সাংঘর্ষিক। কারণ তখন কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ বাধ্যবাধকতা ছিল না। একই সঙ্গে পরিচালকদের পৃথকভাবে ২ শতাংশ শেয়ারধারণের বাধ্যবাধকতা ছিল না।
যেসব কোম্পানি এই আইন জারির আগে বাজারে এসেছে তাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণের বিষয়টি পুর্নবিবেচনার কথা বলে ব্রোকারদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, এরকম অনেক কোম্পানি আছে যাদের পরিচালক সংখ্যা কম। তাদের সম্মিলিত শেয়ার ৩০ শতাংশ হবে না। তারা যদি ব্যবসা ভালো করে তাহলে নগদ লভ্যাংশের সঙ্গে বোনাস শেয়ার দিতে পারবে না। এতে বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বলেন, যেসব কোম্পানি বছরের পর বছর লভ্যাংশ ঘোষণা করে না। তাদের ব্যাপারে বিএসইসি কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। অন্য দেশে এসব কোম্পানিকে ডিলিস্টিং করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অন্যদিকে বিএসইসির একটি সিদ্ধান্তের কারণে বাজারে অনেক ভালো কোম্পানি নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারছে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা এই আইনটি আগের কোম্পানির জন্য সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন। বাজারের একটি স্বার্থন্বেসী মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিএসইসিকে আইনটি করতে বাধ্য করেছে বলেন জানান তারা।
এ ব্যাপারে ব্রোকারদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য সবাইকে সমান দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। কোম্পানি ভালো হলে বিনিয়োগকারীদেরই লাভ। আবার কোম্পানি খারাপ হলে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি। একটি কোম্পানি মুনাফা করে যেমন তার ব্যবসা বাড়াতে নানা উন্নয়ন কাজে ব্যয় করবে পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদেরও মুনাফা দেবে। বাজারে সব কোম্পানি খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসে না। যেসব কোম্পানি বাজারে বিনিয়োগকারীদের লাভ দেয় না সেসব কোম্পানিকে কঠিন আইনের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকলে তারা তাদের শেয়ার বন্ধক রেখে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে না। উপহার হিসেবে কাউকে শেয়ার হস্তান্তরও করা যাবে না। এতদিন সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকলে ওই উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারতেন না। এখন বিক্রি তো করতে পারবেনই না, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ওই শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণও নিতে পারবেন না। এমনকি স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্যের নামে শেয়ার হস্তান্তরও করতে পারবেন না। আর এককভাবে কোনো পরিচালকের ২ শতাংশ শেয়ার না থাকলে তার পরিচালক পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে এমন শেয়ারহোল্ডারকে পরিচালক করে পূরণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারনে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোকে দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং বোর্ডে পৃথক একটি ক্যাটাগরি গঠন করতে হবে।
উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বোনাস শেয়ারসহ কোনভাবে পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে পারবে না। এক্ষেত্রে কোম্পানি রাইট শেয়ার, আরপিও, একত্রীকরণ করার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবে। এছাড়া ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ ছাড়া কোনো পরিচালক এবং উদ্যোক্তা ওই কোম্পানির শেয়ার বিক্রয় বা হস্তান্তর বা বন্ধক রাখতে পারবে না।
কোনো পরিচালকের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থতার কারণে শূন্য পদে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে এমন শেয়ারহোল্ডারদের মধ্য হতে পরবর্তী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে পূরণ করতে হবে।
আর কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান, কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রতি অন্যুন ২ শতাংশ শেয়ার ধারনের জন্য উক্ত কোম্পানি ব্যক্তিকে ওই তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য পরিচালক মনোনীত করতে পারবে।
সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক কোম্পানিতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক।
২০১১ সালের ২২ নভেম্বর তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে বিএসইসি নির্দেশনা জারি করে। পরবর্তী ৬ মাস অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২১ মের মধ্যে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়, কোনো কোম্পানি এ শর্তপূরণ না করা পর্যন্ত রাইট ইস্যুসহ বাজার থেকে নতুন করে মূলধন সংগ্রহ করতে পারবে না। আর কোনো পরিচালক এ শর্ত পূরণ করতে না পারলে তার পদ হারাতে হবে।
এ নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরই ৪ কোম্পানির ১৪ জন পরিচালক আদালতে রিট করেন। আর শেষ পর্যন্ত পরিচালকদের রিট খারিজ করে বিএসইসির সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন আদালত।
শেয়ারবার্তা/ সাইফুল ইসলাম