ব্যবসা সম্প্রসারনে ২০১২ সালে শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ২০০ কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয় ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের জন্য। তবে সেই কোম্পানির পর্ষদ তালিকাভুক্তির পরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নেমেছে। এতে আগে মুনাফা পেলেও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) ধস নেমেছে। এরমধ্যে আবার ২য় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) লোকসান হয়েছে।
তবে শেয়ারবাজারের এ জাতীয় কোম্পানির শেয়ার ব্যবসাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানি মূল ব্যবসাকে পাশ কাটিয়ে শেয়ার ব্যবসা করছে। তা দিয়ে ভালো ইপিএস দেখিয়ে শেয়ার দর ৬০০-৭০০ টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে মুনাফা যেমন দ্রুত হয়, লোকসানও একইভাবে আসে। তাই এখনকার অস্বাভাবিক মুনাফা একসময় লোকসানে পতিত হতে পারে। তাই শেয়ার ব্যবসা করা কোম্পানিগুলোকে কমিশনের নজরদারিতে আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ভালো ব্যবসা দেখিয়ে ইউনিক হোটেলকে ২০১২ সালে শেয়ারবাজারে আনা হয়। ওইসময় প্রতিটি শেয়ার ৭৫ টাকা করে ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানিটির জন্য ১৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এতে প্রতিটি শেয়ারে ৬৫ টাকা করে মোট ১৬৯ কোটি টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা হয়। এই বিশাল দরে শেয়ার ইস্যু করা কোম্পানিটির ব্যবসা তালিকাভুক্তির পর থেকে ভালো যাচ্ছে না। যাতে ব্যবসা সম্প্রসারনে শেয়ারবাজারে আসার পরে কোম্পানিটির মুনাফা সংকুচিত হচ্ছে।
ইউনিক হোটেলের আইপিও পূর্ব ২০১১ সালের ৪.৫৫ টাকার শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে নেমে এসেছে শেয়ারপ্রতি ০.৩৩ টাকা লোকসানে। ১০ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে ৪.৮৮ টাকা বা ১০৭ শতাংশ। যে কোম্পানিটির মুনাফা গত কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী রয়েছে।
এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে শেয়ার ব্যবসায় নামে ইউনিক হোটেল। এতে করে মুনাফাও করে আসছিল। তবে সর্বশেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) ভালো যায়নি। ওইসময় কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে।
দেখা গেছে, আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০) কোম্পানিটির শেয়ার ব্যবসায় মুনাফা হয়েছিল ১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এরমধ্যে ওই সময়ের ২য় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০) মুনাফা হয়েছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর ২১) শেয়ার ব্যবসায় ইউনিক হোটেলে মুনাফা কমে এসেছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকায়। ২য় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২১) ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লোকসান না করলে ওই মুনাফার পরিমাণ বাড়ত।
ইউনিক হোটেল থেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারে আসবে এমন কোম্পানিতেও বিনিয়োগ করা হয়েছে। যেটাকে প্লেসমেন্ট শেয়ার বলা হয়। এই কোম্পানিটি থেকে তালিকাভুক্ত ৩৪ কোম্পানিতে ও ভবিষ্যতে আসতে চাওয়া ৪ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
তালিকাভুক্ত ৩৪ কোম্পানিতে ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার বাজার দর রয়েছে ২১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে। এই কোম্পানিটিতে ইউনিক হোটেলের বিনিয়োগ ৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যার বাজার দর রয়েছে ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এরপরে ২য় সর্বোচ্চ ন্যাশনাল ব্যাংকে বিনিয়োগকৃত ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বাজার দর অর্ধেকেরও কম ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় নেমে এসেছে।
এদিকে ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারে আসতে চাওয়া ৪ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যা ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিজ, চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা স্টিল ও স্টার অ্যালাইড ভ্যানচারে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এছাড়াও ইউনিক হোটেল থেকে সাবসিডিয়ারি ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারে ২৪৬ কোটি ১০ লাখ টাকা ও সহযোগি সোনারগাঁও ইকোনোমিক জোনে ৭৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
এই বিনিয়োগ করতে গিয়ে বড় ঋণে জড়িয়ে রয়েছে ইউনিক হোটেল। কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (৩১ ডিসেম্বর ২০২১) ৪৬১ কোটি ১৫ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ও ২১০ কোটি ৪১ লাখ টাকার স্বল্পমেয়াদিসহ মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে ( ৩১ ডিসেম্বর ২০) ছিল ৬৪১ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়।
শেয়ার ব্যবসায় ধস এবং বিশাল ঋণের সুদের চাপ সত্ত্বেও কোম্পানিটি আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধের লোকসান কাটিয়ে উঠেছে। হোটেলে রুম ভাড়া, খাবার বিক্রি, জায়গা ভাড়া ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় এই উন্নতি হয়েছে। কোম্পানিটির আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে হোটেল থেকে ২৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। যা চলতি বছরের প্রথমার্ধে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি ৫৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা হয়েছে।
এই আয় বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে ২৪ পয়সা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে হয়েছিল লোকসান ১২ পয়সা।
শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে ইউনিক হোটেলের সচিব মো. শরীফ হাসান বলেন, এখন যে বিনিয়োগ দেখছেন, তা নতুন না। এটা ৪-৫ বছর আগে করা হয়েছে। তারপরেও বিস্তারিত জানতে কোম্পানির অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্সের জিএম আবু নাসেরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
জিএম আবু নাসের বলেন, করোনার প্রকোপ কমে আসায় আয় ও নিট মুনাফা বেড়েছে। এরসঙ্গে ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্ত যেমন সহযোগিতা করেছে, একইভাবে সব নিয়মকানুন পরিপালন করায় ওয়েস্টিনের চাহিদাও ছিল বেশি। তবে এখনো করোনা পূর্ববর্তী ব্যবসা ফিরে পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। সামনের আর্থিক হিসাবে বনানিতে অবস্থারনত শেরাটনের আয় যোগ হবে। এতে করে মুনাফা বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শেয়ার ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, মুনাফার উদ্দেশ্যে মূলত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়নি। যেহেতু অলস অর্থ ছিল, তাই শেয়ারবাজার তথা সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটা আমাদের মূল ব্যবসা না।
উল্লেখ্য, ২৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইউনিক হোটেলে সমন্বিতভাবে নিট ২ হাজার ৫৮৪ কোটি ১৭ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। এতে করে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৮৭.৭৮ টাকা।