১. দুই সপ্তাহের বেশি ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছি। চেনা অচেনা, অখ্যাত বিখ্যাত বহু জায়গা। অভিযান শুরু হয় সকাল ১০টায়, শেষ হয় সন্ধার পর। যানজটের কারণে কোন কোনদিন রাতও গড়ায়। যানজনের ভয়াবহতা রাজধানীবাসীর এখন নিত্যদিনের অনুষঙ্গ। মানুষ নিরুপায় হয়ে যানজটের তীব্রতা যেন মেনে নিয়েছে। তাই যানজটের দুর্ভোগকে সাথী করে আমরাও প্রতিদিন রাজধানীর অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য যান্ত্রিকতার শহরে নৈসর্গিক সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ানো নয়। আমাদের উদ্দেশ্য মূলত দুটো। প্রথমত, ডুপডা’র পুনর্মিলনী-২০১৭ উপলক্ষে প্রকাশিতব্য স্বরণিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা; দ্বিতীয়ত, ‘সদস্য কল্যাণ তহবিল’এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা।
২. সদস্য কল্যাণ তহবিল হল সেই তহবিল যে তহবিল হতে ডুপডা’র অস্বচ্ছল সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সম্ভাব্য আর্থিক সহযোগিতা করা হবে এবং তাঁদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ায় সম্ভাব্য আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। সদস্য কল্যাণ তহবিলের স্বপ্নটি ডুপডা’র গোড়াপত্তনকারীরা গত এক যুগ ধরে লালন করে আসছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ এতদিন হয়নি। এবার সেই স্বপ্নের পাল আমাদের তুলতেই হবে। এজন্যই আমরা প্রতিদিন নতুন নতুন প্রত্যাশা নিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিক শহরে ঘুরপাক খাচ্ছি।
৩. যেদিন থেকে ডুপডা’র সাধারণ সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়, সেদিন থেকেই সদস্য কল্যাণ তহবিলটি গঠনের বাসনা মনের গহীনে পুষতে থাকি। কল্যাণ তহিবলটি বাস্তবায়নে আমি একটি রোডম্যাপও তৈরি করে ফেলি। পুনর্মিলনী-২০১৭ যখন দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে, আমিও তখন রোডম্যাপটি বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে পড়ি। দ্বারস্থ হই ডুপডা’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, যাঁর হাত ধরে ডুপডার পথ চলা শুরু হয়েছিল, আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ড. আজিজুন্নাহার ইসলামের। যাকে আমরা ‘শেলু আপা’ বলে ডাকি। শেলু আপার সাথে আমি নানাভাবে সম্পর্কিত। প্রথমত, ভারতীয় দর্শনের ছাত্র হিসাবে আমি কাজী স্যারের অন্যতম স্নেহাস্পদ। দ্বিতীয়ত, আামার শুশুর এবং শেলু আপার বাবা একে অপরের ঘনিষ্ট বন্ধু। শেলু আপার বাবা ডা. বাদশা মিয়া এবং আমার শুশুর এডভোকেট ছাইদুর রহমান কিশোরগঞ্জের দুই পেশার দুই নক্ষত্র। পেশাগতভাবে তাঁরা দু্ই মেরুর বাসিন্দা হলেও রাজনৈতিকভাবে তাঁরা সহমতের। সনাতন একটি রাজনৈতিক দলের একজন সভাপতি, অন্যজন সাধারণ সম্পাদক। বছরে পর বছর জুড়ে তাঁরা রাজনৈতিক দলটির শীর্ষ দুই পদে সমাসীন। অন্যদের পালাবদল হলেও তাঁদের পরিবর্তন নেই। দুজনই সত্য, ন্যায় ও ত্যাগী জীবনের পথিক। আদর্শ ও নীতির কারণে পরপারে গিয়ে তাঁরা আজও আপনজন ও পরিচিতজনদের মনে স্বমহিমায় স্থান করে নিয়েছেন।
৪. সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থেকে আমাদের অভিযান শুরু হয়। চলে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত। আমি আর শেলু আপা অভিযানের স্থায়ী সদস্য। আমাদের সঙ্গে কোনদিন যোগ দেয় ‘৮৫ ব্যাচের শাহ্ মো. আসাদ উল্লাহ, কোনদিন ‘৮৯ ব্যাচের আমিনুল ইসলাম তুহিন, কোনদিন ‘৯০ ব্যাচের সালেহা খাতুন স্নিগ্ধা, আবার কোনদিন ‘৯৭ ব্যাচের শুভ্রা দেবনাথ। তবে বেশিরভাগ দিনই সফরসঙ্গী হিসাবে থাকে তুহিন। এ ধরনের বিরক্তিকর অভিযানে তুহিনের একাগ্রতা ও আন্তুরিকতা অবশ্যই ধন্যবাদযোগ্য।
৫. নিত্যদিনের মতো সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে আমি ও তুহিন সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে আপার ফুলার রোডের বাসায় পৌঁছি। কলিংবেল টিপতেই কাজের বুয়া দরজা খুলে মলিন মুখে বললেন, ‘ম্যাডামতো বাসায় নেই। স্যারের সঙ্গে হাসপাতালে। কাল রাতে স্যার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রাতেই স্যারকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।’ খবরটি শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। কাল সন্ধ্যায়ও স্যারকে সুস্থ্য দেখেছি। তাঁর সঙ্গে অনেক গল্প করেছি। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে স্যারের বেহাল অবস্থা হয়ে গেল। আমরা সময়ক্ষেপন না করে ইবনে সিনা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারি স্যারের হার্টে যে ফেসম্যাকারটি লাগানো হয়েছিল, সেটি দুর্বল হয়ে গেছে। দ্রুত রিপ্লেস করতে হবে।
৬. প্রায় প্রতিদিনই স্যারকে হাসপাতালে দেখতে যাই। স্যারের ইতোমধ্যে অপারেশন হয়েছে। সফলভাবে ফেসম্যাকার রিপ্লেস করা হয়েছে। স্যারকে এখন অনেকটা সুস্থ্য মনে হচ্ছে। শরীরের দকলও অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন আমরা স্যারকে দেখতে যাই, কিন্তু স্যার মনে করছেন আমরা বোধ হয় কাজের জন্য আপাকে তাগাদা দিতে যাই। একদিন স্যার রাখঢাক না রেখে বলেই ফেললেন, ‘আমার জন্য তোমাদের কাজের অনেক হ্যাম্পার হয়ে গেল।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমাদের কাজের কোন হ্যাম্পার হয়নি। আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর আমাদের সব কাজ হবে।’ এক পর্যায়ে আপা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বললেন, ‘আরো দিন দুয়েক তোমাদের স্যারকে এখানে অবজারভেশনে রাখা হবে। তারপর রিলিজ করে দেবে। তবে তোমরা চাইলে আমরা কাল থেকেইে কাজ শুরু করতে পারি।’ আমি বললাম, ‘আপা, স্যার সুস্থ্য হয়ে আগে বাসায় যাক। তারপর আমরা কাজ শুরু করব।’ আপা বললেন, ‘তোমার স্যারকে দেখভাল করার জন্য হাসপাতালের লোকজন আছে। নিজেদের লোকজনও আছে। কোন অসুবিধা হবে না। আমরা কাল থেকেই কাজ শুরু করবো।’
৭. যেমন কথা তেমন কাজ। পরেরদিন স্যারকে হাসপাতালে রেখে আপা আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। সেদিন মতিঝিলের কয়েকটি ব্যাংকের হেড অফিসে আমরা গমন করি। তারমধ্যে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড ছিল অন্যতম। এসব ব্যাংকের হেড অফিস ঘুরে দুপুর আড়াইটা নাগাদ আমরা আসাদের জনতা ব্যাংকে আসি। আসাদ তখন জনতা ব্যাংক, ঢাকা আঞ্চলিক অফিসের ডিজিএম। আঞ্চলিক অফিসের কর্ণধার। অফিসে পদার্পনের সঙ্গে সঙ্গে অনুমিত হল, আমরা যে তাঁর অফিসে আসব-সেটা তাঁর সহকর্মীদের আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিল। এ কারণে অফিসে পদার্পনের সঙ্গে সঙ্গে তার সহকর্মীরা সদলবলে আমাদের সম্ভাষণ জানাল। তাঁদের আন্তরিক অভিভাদনে আমরা সত্যিই বিমোহিত। এদিকে জোহরের নামাজের সময় যায় যায় অবস্থা। আমি ও আপা নামাজ আদায় করার জন্য তাড়াহুড়া করতে থাকি। আসাদ আমাকে তার অফিসকক্ষে এবং আপাকে পাশের একটি নির্জন কক্ষে নামাজ আদায় করার সুযোগ করে দিল। নামাজশেষে আসাদের আতিথিয়তায় দুপুরের ভুরিভোজ। রকমারি সব খাবারের বাহারি আয়োজন। আসাদের সেই আন্তরিক আতিথিয়তা কখনোই যেন ভুলবার নয়।
৮. ভুরিভোজের পর আমরা নানা গালগল্পে মেতে উঠলাম। এরমধ্যে দেখলাম আপা কয়েকবার স্যারের খবরাখবর নিলেন। আমাদের সঙ্গে থাকলেও আপার মনটা পড়ে আছে স্যারের কাছে-এটা সহজেই অনুমেয়। স্যারের প্রতি আপার দুরন্ত ব্যাকুলতায় আমরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া চাওয়ি করতে থাকি। কিন্তু আমাদের দুষ্টমী চাওয়া চাওয়ি আপার নজর এড়ালো না। আপা মনে হল কিছুটা লজ্জাই পেয়েছেন। অন্য প্রসংগ তুলে আপা নিজেই অবস্থার উত্তরণ ঘটালেন। স্যারের প্রতি আপার অশেষ ব্যাকুলতা দেখে আমরা আপাকে অন্য কোথায়ও যাওয়ার অনুরোধ করতে সাহস পেলাম না। অবশেষে স্যারের কাছে আপাকে পৌঁছাতে আমরা আসাদের অফিস থেকেই ইবনে সিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
৯. দু’দিন পর স্যার বাসায় ফেরেন। সামনের দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটি। আমাদের নিত্যদিনকার ঘুরাফিরায়ও বিরতি। তবে ঘুরাফিরায় বিরতি হলেও একেবারে ছুটি নয়। ছুটির দিনে বিকাল বেলায় ডিপার্টমেন্টে রেজিষ্ট্রেশন কমিটি, অর্থ কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটির পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত থাকতে হয়। এছাড়া ছুটির দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শিল্পীদের রিহার্সাল হয়। তাদের রিহাসার্লের অগ্রগতিও দেখতে হয়। এসব কাজ সেরে ফেরার পথে আপার বাসায় যাই। স্যারের খোঁজখবর নেই। কাজকর্মের সর্বশেষ অগ্রগতি স্যার ও আপাকে অবহিত করি।
১০. সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সরকারি দু্জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার রয়েছে। সকাল ১১টায় ঢাকার জেলা প্রশাসক সালাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাতকার। সে ’৮৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী। সততা ও আস্থায় নির্ভরযোগ্য হওয়ায় সরকার তাকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ঢাকার জেলা প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। অন্যজন বজলুল করিম চৌধুরী। তিনি ’৮২ ব্যাচের শিক্ষার্থী। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)’র চেয়ারম্যান। অতিরিক্ত সচিব পদের সৎ ও চৌকুষ এই কর্মকর্তাকে রাজউকের মত চ্যালেঞ্জিং একটি প্রতিষ্ঠানে সরকার কান্ডারি বানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার রয়েছে দুপুর আড়াইটায়। এছাড়াও দুপুর ১টায় দুই হাজার ব্যাচের উদীয়মান ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল জাবিরের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। ধোলাইখালে তার একটি পেট্রোল পাম্প রয়েছে। সেখানেই আমাদের সাক্ষাৎকার।
১১. দিনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে আপার ফুলার রোডের বাসায় পৌঁছে যাই। বাসায় ঢুকতেই দেখি স্যার ও আপা নাস্তার টেবিলে। আ্মরাও নাস্তার টেবিলে বসলাম। আপা আমাদেরকে নাস্তা খেতে বললেন। আমরা বললাম, আমরা নাস্তা খেয়ে এসেছি। তবে চা খেতে পারি। কিছুক্ষণ পর চা এল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে স্যার ও আপার সঙ্গে অনির্ধারিত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমরা আলাপে মত্ত হয়ে গেলাম। এরপর আপা রেডি হওয়ার জন্য তাঁর রুমের দিকে গেলেন। পেছন পেছন স্যারও গেলেন। আমি আর তুহিন ড্রইং রুমে এসে আপার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
১২. কিছুক্ষণের মধ্যেই আপা রেডি হয়ে ফেরলেন। পেছনে স্যারকেও পরিপাটি অবস্থায় দেখা গেল। আমাদেরকে লক্ষ্য করে স্যার বললেন, ‘আজ আমি তোমাদের সফরসঙ্গী হব।।’ আমি এবং তুহিন দুজনেই সমানভাবে আপত্তি করতে লাগলাম। মাত্র দু’দিন আগে স্যার হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। আপনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ্য নন। এ অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আপনার যাওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু আামাদের আপত্তি স্যার আমলেই নিলেন না। মনে হল আপাও চান স্যার ঘরবন্দী না হয়ে আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে আসুক। আপার মৌন সম্মতি দেখে স্যার যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে আমাদের গুরু শিষ্যের বাদানুবাদ আপা বেশ এনজয় করছেন। অগত্যা স্যারের জিদের কাছে আমাদের হার মানতে হল। স্যারকে আমাদের অভিযাত্রায় সামিল করে নিলাম।
১৩. আপার বাসা থেকে যখন যাত্রা শুরু করি তখন প্রায় সাড়ে ১০টা। তুহিন কায়দা করে আগেভাগে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে গেল। আমি নিরুপায় হয়ে পেছনে স্যারের পাশে বসলাম। একপাশে আমি অন্যপাশে আপা এবং আমাদের দুজনের মাঝখানে স্যার বসলেন। স্যারের সঙ্গে এক রকম ঘেষাঘেষি করেই আমাকে বসতে হল। এর আগে কখনো এভাবে স্যারের সঙ্গে বসিনি। স্যার কেন, এভাবে কোন শিক্ষকের সঙ্গেই কখনো বসিনি। হঠাৎ এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম। স্যার আমার কাজুমাজু অবস্থা দেখে বার বার স্বহাস্যে বলতে লাগলেন, “মিয়াজী, তুমি আরও এদিকে এসে বস। স্বাভাবিক হয়ে বস। আমার কোন অসুবিধা হবে না।” কিন্তু স্যার যতই স্বাভাবিক হয়ে বসার জন্য বলুক, আমিতো কোনভাবেই স্বাভাবিক হয়ে বসতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে এক অজানা ভয়, না জানি কোথায় কোনভাবে স্যারের সঙ্গে বেয়াদবি হয়ে যায়।
১৪. এমনি অবস্থার মধ্যে আমরা ফুলার রোড থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ফুলার রোড থেকে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ (রহঃ) মাজার মোড় পর্যন্ত তেমন যানজট দেখা গেল না। কিন্তু মাজার মোড়ে এসে ধৈয্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। এখানে যেন চলছে গণপরিবহনের গণনৈরাজ্য। যে যার মতো গাড়ি রিক্সা বাইক চালাচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশও এখানে নির্বিকার। জনশ্রুতি আছে, গোলাপ শাহ্ মাজারের আশেপাশে একবারের জন্যও কোন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েনি। যদিও মাজারের পাশ দিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ যানবাহন যাওয়া-আসা করে। তীব্র যানজটের কারণে আমাদের গাড়ি এগুচ্ছে পিঁপড়ার মতো। পিঁপড়ারা যেমন সংঘবদ্ধ হয়ে যাওয়া-আসা করে, আমরাও তেমনি সারিবদ্ধভাবে এগুচ্ছি। তবে পিঁপড়াদের মধ্যে সতীর্থদের ল্যাং মারার প্রতিযোগিতা না থাকলেও আমাদের মধ্যে ল্যাং মারার নীরব প্রতিযোগিতা চলছে। পিঁপড়াদের কান নেই বলে তারা শুনতে পায় না। তারা মাটির কম্পন থেকে শব্দ অনুধাবন করে চলে। কিন্তু আমাদের কানও আছে, উপলব্দিও আছে। তারপরও এ্যাম্বুলেন্স হোক কিংবা জরুরী অগ্নি নির্বাপন গাড়ী হোক-সেগুলোর কর্কশ শব্দও আমরা শুনতে পাই না।
১৫. পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় আমরা যখন পৌঁছি তখন প্রায় বারোটা। এ সময় আদালত পাড়ায় পিক হাওয়ার। এলাকাজুড়ে লোকে লোকারণ্য। প্রতিদিন এখানে লক্ষাধিক লোকের আনাগোনা। জজ-ব্যরিস্টার, উকিল-মোক্তার, অফিসার-কর্মচারি, আসামি-স্বাক্ষী, দর্শক-পথচারী হরেক রকমের মানুষের আগমন-নির্গমন। কেউ আসে অন্যের প্রতিহিংসা বা জিঘাংসার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। কেউ আসে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে। কেউ আসে জেলখানার চৌহদ্দির অসহনীয় গ্লানি থেকে মুক্ত হতে। আবার কেউ আসে প্রতিপক্ষকে জেলের ঘানি টানাতে। ন্যায় বিচারের প্রত্যাশী মানুষেরা এখানে হর হামেশায়ই অবিচারের বৃত্তে হোঁচট খায়–এমন অভিযোগ বহু ভুক্তভোগিদের।
১৬. গাড়ী থেকে নেমে আমরা সোজা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছে জানতে পারি তিনি গুলশানে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সাড়ে এগারোটার দিকে অফিস ত্যাগ করেছেন। অনেকবার চেষ্টা করার পর তুহিন মোবাইলে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে জানল, তাঁর অফিসে ফিরতে বিকেল ৫টা বাজতে পারে। কারণ গুলশান থেকে আসার পথে সচিবালয়ে আরো একটি মিটিংয়ে তাঁর অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। আমাদেরকে অন্য একদিন আসার অনুরোধ করেছেন তিনি। আমাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা দেখা গেলেও স্যারের চোখেমুখে দেখা গেল প্রশান্তির ছায়া। তাঁর ছাত্রের বড় অবস্থানের কথা ভেবেই হয়তো তিনি প্রশান্তির নি:শ্বাস নিচ্ছেন। অগত্যা এখানে সময় নষ্ট না করে আমরা ধোলাইখালে জাবিরের অফিসের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকি।
১৭. এই সেই ধোলাইখাল। যার আদি নাম দোলাই খাল। ১৬১০ সালে ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খান চিশতি নগর রক্ষার পরিখা হিসেবে খালটি খনন করেছিলেন। এক সময় এটি বড় খাল বা বিল ছিল। নৌকাবাইচ হতো এখানে। এখন আর সেই খাল বা বিল নেই। ইতিহাস বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এখানে এখন গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা, রাস্তাঘাট এবং ছোট ও মাঝারি গোছের কুটির শিল্প। এখন এটি রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকায় পরিণত। নৌকাবাইচের সেই ধোলাইখাল এখন দেশবাসীর কাছে পরিচিতি পেয়েছে অটোমোবাইলের সাম্রাজ্য হিসেবে। অটোমোবাইলের আসল বা নকল এমন কোনো যন্ত্রাংশ নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শত শত অটোমোবাইল কারখানা। যেখানে দেশি-বিদেশি, নামী-দামী কোম্পানির অবিকল যন্ত্রাংশ এখানে তৈরি হয়।
১৮. জাবির বলেছিল তার পেট্রোল পাম্পটি ধোলাইখালে। আমরা ভাবলাম ধোলাইখালেতো বহু পেট্রোল পাম্প থাকবে না। সুতরাং পেতে বেগ পেতে হবে না। কিন্তু ধোলাইখালে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার পেট্রোল পাম্পটির অস্তিত্ব পাওয়া গেল না। অবশেষে পাওয়া গেল ঢাকা-মাওয়া হাইওয়েতে। আমরা যখন জাবিরের পেট্রোল পাম্পে পৌঁছি তখন সোয়া ১টা। পেট্রোল পাম্পে পৌঁছে জানতে পারি জাবির এখনো অফিসে আসেনি। কয়েকবার চেষ্টা করার পর তাকে মোবাইলে পাওয়া গেল। সে জানাল কাকরাইলে যানজটে আটকা পড়েছে। আমাদেরকে অপেক্ষা করার সর্নিবন্ধ অনুরোধ জানাল। এদিকে পাম্পের লোকজন স্যার ও আপার পরিচয় জেনে আদর-আপ্যায়নের জন্য ছুটাছুটি করতে লাগল। আমরা তাদেরকে বললাম, ‘আপনাদের অস্থির হওয়ার দরকার নেই। জাবির আসুক। যা কিছু খাই, একসাথে খাব।’
১৯. কিছুক্ষণ জাবিরের অফিসে বসার পর দেখলাম স্যার কিছুটা উশখুশ করতে লাগলেন। আমাকে বললেন, ‘চল সামনের দিকে যাই।’ আমি স্যারকে নিয়ে সামনের দিকে এগুতেই দেখি পেছন পেছন তুহিন ও আপা আমাদের অনুসরণ করছেন। আমরা দেখলাম পাম্পের বহিগর্মন পথে একটি টংয়ের দোকান। আমরা সেখানে জড়ো হলাম। বুঝতে পারলাম স্যারের ক্ষুধা লেগেছে। আমারা বেশ ক্ষুধার্ত। দেখলাম টংয়ের দোকানটিতে কম দামের বিভিন্ন পদের বিস্কুট আছে। চাও আছে। আমরা ভাল পদের কয়েক প্যাকেট বিস্কুট নিলাম। দোকানিকে বললাম আমাদের রং চা দিতে। টংয়ের দোকানটিতে কম দামের চা-বিস্কুট হলেও আমরা বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খেলাম। বোধহয় ক্ষুধার কারণেই কম দামের বিস্কুটও অনেক মজাদার মনে হয়েছে।
২০. মোবাইলে ঘড়ি দেখলাম। সোয়া ২টা বেজে গেছে। স্যারকে বললাম, স্যার রাজউকের চেয়া্রম্যানের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকার আড়াইটায়। এখানে আমাদের আর অপেক্ষা করা সঠিক হবে না। আমাদের এখনই রওয়না হওয়া দরকার। স্যার এবং আপাও সম্মতি একমত হলেন। স্যার বললেন, পাম্পের লোকজনকে বলে আস। আমরা অন্য একদিন আসব। তারা যেন আমাদের ভুল না বুঝে। এরপর আমরা রাজউকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। গাড়ীতে উঠে রাজউকে আমাদের অ্যালামনাইর ৪/৫ জন সদস্য রয়েছে, তাদেরকে আমাদের আসার সংবাদ জানালাম।
২১. রাজউকে যখন পৌঁছি তখন সোয়া তিনটা। দেখলাম বজলু ভাই বাইরে যাওয়ার জন্য গাড়ীতে উঠছেন। আমি দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে বজলু ভাইয়ের গাড়ীর কাছে গিয়ে গাড়ীর জানালার কাঁচে টোকা দিলাম। তিনি জানালার কাঁচ নামালেন কিন্তু বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘আমি আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আমার মিটিং আছে সাড়ে তিনটায়। এখন আর আমার পক্ষে সময় দেয়া সম্ভব নয়। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আপনাদের আর একদিন আসতে হবে।” এই বলে তিনি ড্রাইভারকে যেতে বললেন।
২২. আসলে আমাদেরই দোষ। আমরা সময়মতো আসতে পারিনি। তিনিতো আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। মিটিংতো তাঁকে সময়মতো যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে মিটিং বলে কথা। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেখানে মিটিং হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সময়মতোই হাজির হতে হয়। এখন তিনটার বেশি বাজে। সাড়ে তিনটার মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়া সত্যিই তাঁর খুব কষ্ট হবে। আমাদের গাড়ী কয়েকটি গাড়ীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়ীতে এসে স্যার ও আপাকে বিষয়টি জানালাম। ইতোমধ্যে দেখলাম রাজউকে আমাদের অ্যালামনাইর সদস্যরা যারা স্যার ও আপার ছাত্র-ছাত্রী, তারা আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সদলবলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ’৯৬ ব্যাচের ছাত্র রাজউকের উপ-পরিচালক (স্টেট) আবদুল হামিদ, (২০০০ ব্যাচের ছাত্র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আবুদল হামিদ, ‘৮৮ ব্যাচের ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিন এবং ২০০৫ ব্যাচের সহকারি পরিচালক (স্টেট) সোহাগ। ’৯৬ ব্যাচের আবদুল হামিদ সিনিয়র হওয়ার আমরা সবাই তার রুমেই গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমাদের সামনে হরেক রকমের ফলের সমাহার। এখন মধ্যাহ্নভোজের শেষ সময়। ফলটল কারোরই ভাল লাগছে না। কিন্তু তাদেরকো আমরা সেটা বলতে পারছি না। উপায়হীন হয়ে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ভদ্রতা দেখানোর জন্য সামান্য ফল মুখে দিলাম্। তারপর সেখান থেকে বিদায় নিলাম। কিন্তু বিদায় নিয়েও বিদায় হল না। আমাদেরকে সোহাগের রুমেও যেতে হল। সেখানেও একই জাতীয় ফলের স্বাদ অনিচ্ছাসত্বেও গ্রহণ করতে হল।
২৩. আসলেই ঠিক। অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে মিটিং বলে কথা। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিটিং হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সময়মতো হাজির হতে হয়। এখন তিনটার বেশি বাজে। সাড়ে তিনটার মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়া সত্যিই খুব মুশকিল হবে। আমি সংক্ষেপে আমাদের বিলম্বের কারণ তাঁকে অবহিত করে তাঁকে ছেড়ে দিলাম। তবে আমাদের আসার কারণ বলতে পারলাম না। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে অন্য একদিন আসার অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। আমাদের গাড়ী কয়েকটি গাড়ীর পেছনে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গাড়ীতে এসে স্যার ও আপাকে বিষয়টি জানালাম। ইতোমধ্যে দেখলাম রাজউক অফিসে স্যার ও আপার যেসব ছাত্ররা চাকুরী করেন, তারা আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সদলবলে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন উপ-পরিচালক (স্টেট) আবদুল হামিদ ( ’৯৬ ব্যাচের ছাত্র), উপ-পরিচালক (প্রশাসন) সেও আবুদল হামিদ, ‘৮৮ ব্যাচের সাবিনা ইয়াসমিন এবং সহকারি পরিচালক (স্টেট) সোহাগ (২০০৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী)। উপ-পরিচালক (স্টেট) আবদুল হামিদ সিনিয়র হওয়ার আমরা সবাই তার রুমেই গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমাদের সামনে হরেক রকমের ফল-ফলাদির আয়োজন। এখানেই শেষ নয়, সোহাগের রুমেও আমাদেরকে পুনরায় ফলমূলের স্বাদ নিতে হয়েছে।
২৪. রাজউক থেকে যখন বের হলাম তখন প্রায় সাড়ে ৪টা। স্যারকে নিয়ে কোথায়ও লাঞ্চ করতে চাইলাম। স্যার বললেন, ফলটল খাওয়াতে এখন আর ক্ষুধা নেই। চল বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করব। স্যার বললেন, আমি আসাতে তোমার আজ সব প্রোগ্রামই বন্ডুল হয়ে গেল। তোমাদের কোন লাভই হল না। কিন্তু স্যারকে সঙ্গ আমাদের যে কী লাভ হয়েছে, সেটা স্যারকে বুঝাতে পারলাম না। প্রথমত: সারাটি দিন আমাদের প্রিয় শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকলাম। এটা কম প্রাপ্তি নয়। দ্বিতীয়ত: কোন কাজের সফলতায় ধৈর্য্যধারণ কতটা অপরিহার্য-তা স্যারের সঙ্গে থেকে নতুন করে উপলব্দি করলাম। তৃতীয়ত: যেকোন সফলতার পেছনে অধ্যাবসায় জড়িত-স্যারের সঙ্গে এসে আরেকবার বুঝতে পারলাম।