চট্টগ্রাম ইপিজেডের বিনিয়োগকারী নাজমুল আবেদিন। তার মালিকানাধীন এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার লিমিটেড এবং নর্ম আউটফিট লিমিটেডের কারখানা এক বছর ধরে বন্ধ ছিল। তাই পাওনা আদায়ে কিছুদিন আগে বেপজা কর্তৃপক্ষ নিলামে ২৫ কোটি টাকায় এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার এবং নর্ম আউটফিট লিমিটেড বিক্রয় করে দেয়।
এ বিক্রয় আয় থেকে শ্রমিকের বকেয়া বেতন এবং এনবিআরের বকেয়া পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে বেপজা কর্তৃপক্ষ। যদিও এনবিআরের পাওনা ২২২ কোটি টাকা। তবে আইনে না থাকায় এক টাকাও পাবে না ব্যাংকগুলো। তাই প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে চার ব্যাংকের বকেয়া ও খেলাপি পাওনা ২৮৫ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (বেপজা) কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, নাজমুল আবেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পড়াশোনা শেষ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরিতে যোগ দেন। পেশাগত সাফল্যে অল্প সময়ে করপোরেট জগতে পরিচিত লাভ করেন। কিন্তু পেশাগত অনিয়মের অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। এর কয়েক বছর পর দেশে ফিরে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) পোশাক খাতের ব্যবসায় আসেন। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার, নর্ম আউটফিট লিমিটেড এবং কোল্ড স্কুল প্লে লিমিটেড নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
নিজের ব্যাংকে কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে অল্প মূলধনি প্রতিষ্ঠানকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করে ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার কাছে ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ১২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আর নর্ম আউটফিটের কাছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ২৬ কোটি ও ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ৩৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থাৎ চারটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ২৮৫ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ২২২ কোটি টাকা বন্ড সুবিধা অপব্যবহার, পোশাক কারখানার এক হাজার ৩৭২ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বেপজার পাওনা, অ্যাকসেসরিজ সাপ্লায়ারদের আরও অন্তত ৫৩ কোটি টাকা না দিয়েই গোপনে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এই ব্যবসায়ী ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন।
এরপর থেকে বন্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠান তিনটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আর গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মালিকপক্ষের সাড়া না পেয়ে বেপজার পাওনা এবং ১০ মাসের শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থতায় নাজমুল আবেদীনের মালিকানাধীন তিন প্রতিষ্ঠানকে গত ২৩ নভেম্বর নিলামে তুলেছে চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। আর নিলামে আগ্রহী ক্রেতারা অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার লিমিটেড ইপিজেটের চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কোন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়াল বিডি কোম্পানি ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং নর্ম আউটফিট লিমিটেড ইপিজেটের কোরিয়ান বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এইচকেডি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড আট কোটি ২৪ লাখ টাকায় কিনে নেয়, যা ইতোমধ্যে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলোর মালিকানা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে এঅ্যান্ডবি আউটার লিমিটেড দিয়ে শুরু করেন। এরপর ২০১৭ সালের শেষ দিকে স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর এ কে এম জাহেদ হোসাইনের নামে নর্ম আউটফিট নামের কারখানাটি কিনে নেন নাজমুল। যদিও এঅ্যান্ডবি আউটারের সাব কন্ট্রাক্টের কাজ করত নর্ম আউটফিট। সেই প্রতিষ্ঠানটি মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কীভাবে ব্যাংক থেকে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেল সেটাই রহস্যজনক। মনে হচ্ছে, নাজমুল কারখানাটি কিনেছেনই ব্যাংকঋণ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে। মনে হচ্ছে তার এমন ইচ্ছা ছিল। এখানে ব্যাংকগুলোরও দোষ আছে। কীভাবে এত টাকা ঋণ দেয়!
অন্যদিকে পাওনাদার ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, ব্র্যাক ব্যাংক ১০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে গত ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছিল। অন্যদিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক চলতি বছরের ১২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খেলাপি আদায়ে মামলা করেছে। তবে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংক পাওনা আদায়ে মামলা দায় করেনি। যদিও ঋণগ্রহীতা নাজমুল আবেদিন দেশে না থাকায় আইনি পদক্ষেপের পরও এ পাওনা আদায় হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কারণ এ ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংকের কাছে কোনো সিকিউরিটি জমা নেই।
এ বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের আঞ্চলিক প্রধান (চট্টগ্রাম) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘নাজমুল আবেদিনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড বি আউটার ওয়্যার লিমিটেড আমাদের খেলাপি গ্রাহক। গত বছরের আমরা অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। যদিও দেড় বছর আগে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। আর দেশে আসেননি। তখন থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে। ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নিলাম বিক্রয় করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল তা শুনেছি। তবে বিক্রয় হয়ে গেছে তা জানি না। আর ইপিজেডের আইন অনুসারে শ্রমিকের পাওনা ও সরকারি পাওনা পরিশোধ আগে। এ কারণে ব্যাংকের পাওনা আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তবে মামলা তো চলমান আছে। দেখি কী হয়।’
সিইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ বলেন, ‘নাজমুল আবেদিনের মালিকানাধীন এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার লিমিটেড এবং নর্ম আউটফিট লিমিটেড এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটি সম্প্রতি নিলামের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকায় বিক্রয় হয়েছে। আর এ পাওনা থেকে এক হাজার ৩৭২ জন শ্রমিকের প্রায় ৯ কোটি টাকা বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। বাকি টাকা এনবিআরকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এবারই প্রথম বেপজা তার বকেয়া পাওনা আদায় করছে না। এছাড়া বেপজা আইন অনুসারে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের সুযোগ নেই।