পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি ঢাকা ডাইং বর্তমানে অনেকটাই অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে। কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরেই বোর্ডসভা এবং এজিএম করছে না। বিনিয়োগকারীরাও কোম্পানিটির সব রকম তথ্য থেকে অজ্ঞাত। তারপরও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে কোম্পানিটির দর। আজ কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে এবং সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, আজ কোম্পানিটির সর্বশেষ এবং সর্বোচ্চ ১৪ টাকা ৩০ পয়সায় দরে লেনদেন হয়েছে। আজ কোম্পানিটির লেনদেন শুরু হয় ১৪ টাকা ৩০ পয়সা দিয়ে। এর আগের দিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৩ টাকায়। আজ কোম্পানিটির সর্বনিম্ন দর ছিল ১৩ টাকা ৭০ পয়সা। আজ কোম্পানিটির দর বেড়েছে এক টাকা ৩০ পয়সা বা ১০ শতাংশ, যা সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা। এদিন এ কোম্পানির ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৩৭টি শেয়ার ৩৭৩ বার হাতবদল হয়, যার বাজারমূল্য ২ কোটি ২২ লাখ ২০ হাজার টাকা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে অসংখ্য ভালো কোম্পানি রয়েছে। যেগুলোতে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ না থাকায়, সেগুলোর দর ফেসভ্যালুর কাছাকাছি অবস্থান করছে। কোম্পানিগুলোর পিই রেশিও এবং অন্যান্য তথ্য বিবেচনায় বিনিয়োগ উপোযোগী হওয়া সত্বেও দর তলানীতে অবস্থান করছে। অথচ ঢাকা ডাইংয়ের মতো প্রায় অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা কে বা কারা এত টাকার বিনিয়োগ করছে এবং ধারাবাহিকভাবে দর বাড়াচ্ছে। অবশ্যই এর পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মত, ২০১০ সালের মহাধসের কবলে পড়ে দেশের পুঁজিবাজার। এরপর থেকে বাজার উন্নয়নে একাধিক ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া সত্বেও বাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি। অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে পুঁজিবাজার থেকে বেরিয়ে গেছে। মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো ভালো ডিভিডেন্ড এবং ভালো ইপিএস দেখিয়েও বিনিয়োগকারীদেরকে টানতে পারছে না, সেখানে কিভাবে এমন একটি অস্তিত্ব সংকটে থাকা কোম্পানি দর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। অবাক লাগে এরপরও কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোম্পানিটির দর বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, যে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে তার সব রকম তথ্য জানতে হবে। শুধুমাত্র গুজবের উপর ভিত্তি করে যে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ মানে পুঁজিকে ঝুঁকিতে ফেলা। ঢাকা ডাইংয়ের মতো কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে মুনাফার আশা করা বোকামী ছাড়া আর কিছুই না।
জানা যায়, কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৭ সালে বোর্ড সভা করলেও কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেনি। ওই বছর কোম্পানিটি ধারাবাহিকভাবে লোকসান দেখিয়েছে। এর মধ্যে- প্রথম প্রান্তিকে ৭৯ পয়সা, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭৮ পয়সা এবং তৃতীয় প্রান্তিকে ৯৪ পয়সা লোকসান দেখিয়েছে। যদিও কোম্পানিটি ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।
কোম্পানিটির অতীত তথ্য উপাত্ত ঘেটে দেখা যায়, নানা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে কোম্পানিটি। ২০১৭ সালে কোম্পানির সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়নের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান।
নেট ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নেগেটিভের পাশাপাশি সমাপ্ত হিসাব বছরে ঋণ ও সুদ পরিশোধ করেনি ঢাকা ডাইং। কোম্পানিটির গ্যাস বিতরণ কোম্পানি থেকে সংযোগ বিছিন্ন রয়েছে। এর ফলে বর্তমানে কোম্পানিটির ডায়িং বিভাগ কাজ করছে না। তবে ওয়েভিং ও স্টিচিং বিভাগ চালু রয়েছে।
ঢাকা ডায়িং স্টক থেকে পণ্য বিক্রি বেশিরভাগই নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কোম্পানিটি এখনও চালু রয়েছে এ ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। জানা গেছে, কোম্পানিটি শ্রমিকদের প্রফিট ও ওয়েলফেয়ার ফান্ডের ৩ কোটি ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩ টাকা দীর্ঘদিন থেকে বিতরণ করেনি। এর ফলে কোম্পানিটি শ্রম আইন-২০০৬ লঙ্ঘন করেছে।
কোম্পানিটি স্থায়ী সম্পদের পুর্নমূল্যায়ন ৫ বছর আগে করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাকাউন্ট স্ট্যান্ডার্ডস অনুযায়ী সম্পদের পুর্নমূল্যায়ন সঠিক সময়ে করতে হবে। নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মতে, কোম্পানিটির পুনরায় সম্পদ পুর্নমূল্যায়ন প্রয়োজন।
৩০ জুন ২০১৬ সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানি জিটিসিএল ঢাকা ডায়িংয়ের গ্যাস সরবরাহের সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করেছে। এ কারণে কোম্পানিটির ডায়িং বিভাগ সম্পূর্ণ বন্ধ আছে। তবে এখনও এ কোম্পানির ওয়েভিং ও স্টিচিং বিভাগ চালু আছে। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটি ‘গোয়িং কনসান্স’ বা চালু কোম্পানি হিসেবে নিজেদের দাবি করেছে।
নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান আরও মন্তব্য করেছে, ঢাকা ডায়িংয়ের চলতি মূলধনে এরই মধ্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে ২০১৬ সমাপ্ত হিসাববছরে ব্যাংকঋণ ও ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে পারেনি। এদিকে কোম্পানিটির ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের তিন কোটি ১৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা অনেকদিন ধরে অবণ্টিত অবস্থায় পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুসরণ করা হচ্ছে না। বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করেছে, কোম্পানিটি যে বইয়ে হিসাব বিবরণীতে এর নানাবিধ স্থাবর সম্পদের (জমি, যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিক) হিসাব রাখে, তাতে আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত তথ্য রাখা হয়নি। এসব সম্পদের মূল্যের ব্যাপক রদবদল হয় বিধায় প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে এসব সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির নেট ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল নেগেটিভ রয়েছে। কোম্পানি ২০১৬ সমাপ্ত হিসাব বছরে ঋণ ও সুদ পরিশোধ করেনি। কোম্পানির গ্যাস বিতরণ কোম্পানি থেকে সংযোগ বিছিন্ন রয়েছে। এর ফলে বর্তমানে এর ডাইং বিভাগ কাজ করছে না; কিন্তু উইভিং ও স্টিচিং বিভাগ চালু রয়েছে। ঢাকা ডাইংয়ের স্টক থেকে পণ্য বিক্রি বেশিরভাগই সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি এখনও চালু রয়েছে এই ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া, কোম্পানি শ্রমিকদের প্রফিট ও ওয়েলফেয়ার ফান্ডের ৩ কোটি ১৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩ টাকা দীর্ঘ দিন থেকে বিতরণ করেনি। এর ফলে কোম্পানি শ্রম আইন-২০০৬ লঙ্ঘন করেছে।
এদিকে, ২০১৫ সালে ৮ নভেম্বর ঢাকা ডায়িংয়ের পরিচালনা পর্ষদ ১.৫:১ হারে রাইট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে, বিদ্যমান ১টি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে ১.৫ রাইট শেয়ার পাওয়ার কথা বিনিয়োগকারীদের। এ হিসেবে মোট ১৩ কোটি ৭ লাখ ৩০ হাজার ১৭৯টি রাইট শেয়ার ইস্যু করার কথা। অভিহিত মূল্য ১০ টাকা দরে এই শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব করে পর্ষদ। এ হিসেবে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে ১৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা সংগ্রহ করতো কোম্পানিটি। কিন্তু বিএসইসি রাইট শেয়ারের আবেদন বাতিল করে দেয়।
এর আগে ২০১৩ সালেও ঢাকা ডায়িং আরেকবার রাইট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু আইনি শর্ত পূরণ না হওয়ায় সেবারও কোম্পানিটির রাইট আবেদন প্রত্যাখ্যান করে বিএসইসি।
এদিকে, নানা সমস্যা ও অস্তিত্ব সঙ্কটের কারণে কোম্পানিটির দর ধারাবাহিকভাবে কমে গত বছর ১০ মার্চ ২ টাকা ৭০ পয়সায় নেমে আসে। কিন্ত গত বছরের জুন থেকেই কোম্পানিটির দর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৯ টাকা ৮০ পয়সায় ওঠে আসে। এরপর কোম্পানিটির দর ৭ টাকা থেকে ৯ টাকা ৭০ পয়সার মধ্যে ওঠানামা করে। কিন্ত গত ১২ কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির দর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আজ এ কোম্পানির শেয়ার দর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ কোম্পানির এই অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পেছনে কি কারণ আছে তা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি থেকে বাঁচাবেন। আর এ কোম্পানির অতীত কার্যক্রম দেখার পর কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করবেন কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। কারণ পুঁজি আপনার, দায়িত্বও আপনার।