স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে ১৯৭২ সালে যে যাত্রার সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট নিয়ে আসছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, যার আকার হতে পারে ৬ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি।
এই হিসাবে ৫০ বছরে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয়ের ফর্দ বাড়ছে ৭৭০ গুণ।
৩ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল; তা পাস হবে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর।
কোভিড-১৯ মহামারির উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের মধ্যে গতবারের মতো এবারও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন।
১ জুন শুরু হবে বাজেট অধিবেশন। এবারও বাজেট অধিবেশন হবে খুবই সংক্ষিপ্ত। ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে বয়স্ক সংসদ সদস্যরা যথাসম্ভব অধিবেশনে কম উপস্থিত থাকবেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারের ১২ জন অর্থমন্ত্রী (অথবা অর্থ উপদেষ্টা অথবা সামরিক শাসক) ৪৭টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন এর আগে।
মুস্তফা কামাল ২০১৯ সালের ১৩ জুন তার প্রথম বাজেট (২০১৯-২০ অর্থবছর) উপস্থাপন করেছিলেন। ২০২০ সালের ১১ জুন উপস্থাপন করেছিলেন দ্বিতীয় বাজেট। ৩ জুন উপস্থাপন করবেন তৃতীয় বাজেট।
সংসদে সমান ১২ বার বাজেট পেশ করে রেকর্ড করেছেন প্রয়াত এম সাইফুর রহমান এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে টানা ১০টি বাজেট দেয়ার রেকর্ড শুধু মুহিতের।
শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট পেশ করেছেন মুহিত। এর আগে তিনি এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ এই দুই অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনে একটি স্থানে এখনও অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ, যিনি সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী মোট যে ১৩ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তারা ছিলেন হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সেনা কর্মকর্তা অথবা অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী। এরা কেউই পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন না।
এক অর্থবছরে দুবার বাজেট উপস্থাপনের উদাহরণও আছে বাংলাদেশে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন। এর পর নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে মূল আর্থিক কাঠামো ঠিক রেখে নতুন করে বাজেট উপস্থাপন করেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া।
বাজেট যে শুধু অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দিয়েছেন, তা নয়। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে তিনটি বাজেট উপস্থাপন করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ তিনটি, শাহ এএমএস কিবরিয়া ছয়টি, এম সাইদুজ্জামান চারটি বাজেট দেন। অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দুটি এবং ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একটি বাজেট পেশ করেন।
এরশাদ সরকারের দুই অর্থমন্ত্রী এম এ মুনিম দুটি এবং ওয়াহিদুল হক একটি বাজেট উপস্থাপন করেন।
বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে মীর্জা নুরুল হুদা একটি বাজেট দেন। খন্দকার মোশতাক সরকারের আমলে দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট দেন এ আর মল্লিক।
চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের চারজন অর্থমন্ত্রী ২১টি বাজেট দিয়েছেন।
বিএনপির তিন মেয়াদের শাসন আমলে তিনজন ১৬টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন।
জাতীয় পার্টির আমলে নয়টি বাজেট চারজন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন। তিনটি বাজেট দিয়েছে দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। এই তিন মেয়াদের প্রথম অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, নতুন বাজেটে তা ৬ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার মতো হতে যাচ্ছে, যা শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
এভাবে প্রতিবছরই বেড়েছে বাংলাদেশের বাজেট।
করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকেই বিপর্যস্ত অর্থনীতি। উৎপাদনের চাকা ঘোরেনি বহুদিন। নিম্ন আয়ের মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও রপ্তানি আয় কমেছে। আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকই হয়েছে নেতিবাচক।
এরই মধ্যে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ধাক্কা সব হিসাবনিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছে। আর সে কারণেই এবার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির উচ্চহার ধরা থেকে শেষ পর্যন্ত সরে আসছে সরকার।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ধরা হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মেনে নিয়ে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণের উচ্চাভিলাষী পথে আর যাচ্ছে না সরকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১ শতাংশ পয়েন্টের বেশি কমানো হবে। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ শতাংশের ঘরে থাকবে বলে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মহামারির কারণে ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা এক দফা কমিয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এখন আরেক দফায় তা কমিয়ে ৬ শতাংশের নিচে আনা হবে বলে আভাস মিলেছে।
বাজেটকে অংশীদারিমূলক করতে প্রতিবছর যে প্রাক-বাজেট আলোচনা হয়, গত বছরের মতো এবারও করোনার কারণে তা খুব বেশি হয়নি। অর্থ বিভাগ অনলাইনে কিছু বৈঠক করেছে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু বৈঠক করেছে সরাসরি, কিছু করেছে অনলাইনে।
নতুন বাজেট নিয়ে বেশিকিছু বলতে রাজি হননি অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
তিনি শুধু বলেছেন, ‘প্রতি মুহূর্তে আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করছি। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই নতুন বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।
‘কোভিড মোকাবিলার জন্য ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে নতুন এডিপি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আমাদের এবারের বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হবে করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা। আশা করছি সেটা সফল হবে।’