দেশের আবাসনশিল্প করোনার থাবায় মহাসংকটে আছে। গত এক বছরের অর্থনৈতিক মন্দা, জমির আকাশচুম্বী মূল্য ও বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণে জমির সংকট, দেশের অভ্যন্তরে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তিতে সাময়িক স্থগিতাদেশ এবং নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। ওদিকে শেয়ারবাজারের ধস এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ায় এই খাতে ভয়াবহ তারল্য সংকটসহ মূলধন ব্যয় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনা মহামারি মোকাবেলা করতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আবাসন খাতের নিবন্ধন ব্যয় ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ, ভ্যাট ও কর হ্রাস, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, ১০ বছরের জন্য বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ এবং ট্যাক্স হলিডে সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে আবাসন খাতের সংগঠন বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) এবং রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
আবাসন খাতের সংগঠনগুলো সূত্রে জানা যায়, করোনার কারণে গত এক বছরে আবাসন খাতে বিক্রির পরিমাণ ৬০ শতাংশ এবং এই খাতে উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্প গ্রহণের হার ৭৫ শতাংশ কমেছে। আজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের কাছে আবাসন খাতের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা চলমান সংকট কাটিয়ে উটতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তিতে একগুচ্ছ প্রস্তাব জমা দেবেন।
রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘ফ্ল্যাট এবং জমি কেনার ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে অতিমাত্রার নিবন্ধন ব্যয় বিদ্যমান। একই সঙ্গে পুরনো ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ফের নতুন ফ্ল্যাটের সমান নিবন্ধন ব্যয় করতে হয়, যা অযৌক্তিক। নিবন্ধন ব্যয় ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া নামমাত্র নিবন্ধন ব্যয় নির্ধারণ করে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন করা প্রয়োজন।’ গৃহায়ণশিল্পের উদ্যোক্তাদের আয়কর হ্রাস এবং অর্থপাচার রোধে কোনো শর্ত ছাড়া আবাসন খাতে ১০ বছরের জন্য অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান আলমগীর শামসুল আলামিন।
আবাসন খাতের সংগঠন থেকে হিসাব কষে বলা হয়েছে, বর্তমানে ফ্ল্যাট এবং জমি কেনার ক্ষেত্রে নিবন্ধন ব্যয় ১৪-১৬ শতাংশ। করোনাকালীন সংকট কাটিয়ে আবাসন খাতে গতি আনতে গেইন ট্যাক্স ২ শতাংশ, স্ট্যাম্প ফি ১.৫ শতাংশ, নিবন্ধন ফি ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ১ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর ১.৫ শতাংশ, এভাবে মোট ৭ শতাংশ নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নিবন্ধন ব্যয় বেশি। সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের নিবন্ধন ব্যয় ৪-৭ শতাংশের বেশি না। নির্মাণ ব্যয় হ্রাস ও আনুষঙ্গিক ব্যয় কমাতে ভ্যাট ও কর হ্রাস করার প্রস্তাব জানিয়ে আবাসন খাতের সংগঠন থেকে বলা হয়, বর্তমান আইনে ডেভেলপারকে ১৫ শতাংশ হারে উেস কর কর্তন করে জমা দিতে হয়। এ হার কমিয়ে ৪ শতাংশ ধার্য করা। সাপ্লায়ার ভ্যাট ও উেস কর সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে পাঁচ বছরের জন্য ডেভেলপারদের অব্যাহতি দেওয়া। নিবন্ধন ব্যয় কমিয়ে আবাসন খাতে ‘সেকেন্ডারি বাজার’ ব্যবস্থার প্রচলন করা। নিবন্ধন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, গেইন ট্যাক্স ইত্যাদি বিদ্যমান করহার হ্রাস করে ৩.৫ শতাংশ হারে দ্বিতীয়বার ফ্ল্যাট বা প্লট ক্রয়-বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করা। এতে একই সম্পত্তি একাধিকবার হাত বদলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশে আবাসনশিল্পের জন্য সেকেন্ডারি বাজার সৃষ্টিসহ উন্নত দেশের মতো রিয়েল এস্টেট মার্কেট ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
প্রস্তাবে আরো আছে, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনকে তহবিল প্রদানের মাধ্যমে আবাসন খাতের ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করা। আবাসন খাতের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এই খাতকে আরো গতিশীল এবং সত্যিকার অর্থে স্বল্প আয়ের মানুষের মাথা গোঁজার স্বপ্নকে সার্থক করতে (সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত মধ্য ও নিম্ন আয়ের) ক্রেতা সাধারণের জন্য অন্তত একটি ফ্ল্যাট কিনতে সহজ শর্তে সর্বোচ্চ ৬ থেকে ৭ শতাংশে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের টাকা কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধের ব্যবস্থা করা। ক্রেতা, জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে বিশেষ ঋণের প্রচলন করা। ঢাকা জেলাসহ বিভিন্ন মেট্রোপলিটন এলাকা, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে পাঁচ বছরের জন্য এবং পৌরসভার বাইরের এলাকায় নগরায়ণকে উৎসাহিত করতে ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডে ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
সংগঠনগুলোর লিখিত বক্তব্যে আবাসন খাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে এমন দাবি করে বলা হয়েছে, বাসস্থান সরবরাহের মাধ্যমে দেশের আবাসন সমস্যার সমাধান করছে, কর্মসংস্থানসহ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে, লিংকেজ শিল্প বিকাশে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে, পরিবেশ সমৃদ্ধ ও ঝুঁকিমুক্ত অবকাঠামো বিনির্মাণ হচ্ছে, সরকারের রাজস্ব উপার্জন বৃদ্ধি পাচ্ছে।