আর্থিক অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের কারণে চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে বেশ কিছু নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) এবং পিপলস লিজিং এন্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স। ইতোমধ্যে পিপলস লিজিং বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কারণে বিআইএফসির অবসায়ন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। আর কোনো বিকল্প না থাকায় বিআইএফসির অবসায়ন চেয়ে গত বছর অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির।
আরো নয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে দুই অঙ্কের ঘরে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এতই নাজুক যে, তারা গ্রাহকের ‘এফডিআরের’ (আমানত) টাকা পর্যন্ত ফেরত দিতে পারছে না। টাকা না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন অনেক গ্রাহক।
সূত্রমতে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। এর মধ্যে ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই ‘রেড জোন’ বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেড জোনে থাকা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করতে পারছে না। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন সক্ষমতা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে হলুদ তালিকায় রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানকে কলমানি ও মেয়াদি আমানত দিয়ে বিপাকে আছে ব্যাংকগুলোও। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতের সুদও পরিশোধ করছে না। এ নিয়ে হাজারো অভিযোগ জমা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
জানা গেছে, সাবেক সচিব, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সুপরিচিত অনেকেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা ফেরত না পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন। এদের অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের। এর মধ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে পিপলস লিজিং থেকে ঋণের অধিকাংশই তুলে নিয়েছেন সাবেক পরিচালকরা। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে ৫ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ জুন অবসায়ক নিয়োগ করেছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে খারাপ পর্যায়ে আনার পেছনে অভিযুক্ত সাবেক আট পরিচালক ও তিন কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ এবং সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। প্রতিষ্ঠানটিতে আমানতকারীদের জমানো ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা কোন উপায়ে ফেরত দেয়া যায় তা নিয়ে কাজ চলছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকা পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৫০ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ প্রতিষ্ঠানটি এতটাই সংকটে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) মতো টাকা নেই। পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের উন্নতি হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, যা পূরণের সক্ষমতা না থাকায় বিশেষ বিবেচনায় পাঁচ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের কাছ থেকে কলমানি ও মেয়াদি আমানত নিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুদের টাকা পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ জন্য দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। প্রায় একই কথা বলছেন রেড জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানতকারীরা।
শেয়ারবার্তা / হামিদ