পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের বিভিন্ন ইস্যুতে দুই নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ ও অনুসন্ধানমূলক নিরীক্ষা করিয়েছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জীবন বীমা খাতের কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি)। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী নিরীক্ষার মুখে পড়েছে কোম্পানিটি।
সম্প্রতি বিএসইসির পক্ষ থেকে ডেল্টা লাইফে বিশেষ নিরীক্ষা করার জন্য ম্যাবস অ্যান্ড জে পার্টনার্স চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে বিশেষ নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুবাইয়ে রোড শো-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ডেল্টা লাইফে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করার কথা জানান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তা খতিয়ে দেখতেই বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বিএসইসি। কোম্পানিটির চলমান সমস্যা নিয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। দুই পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য থাকায় কোম্পানির প্রকৃত চিত্র জানতে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ডেল্টা লাইফের আর্থিক প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক নিরীক্ষামান অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছে কিনা, কোম্পানিটির জীবন বীমা তহবিলর যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কিনা, কোম্পানিটি স্বচ্ছতা ও সুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে কিনা- এ বিষয়গুলো বিএসইসির নিয়োগ করা বিশেষ নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান খতিয়ে দেখে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন ও কমপ্লায়েন্স এবং বিশেষ নিরীক্ষার মতো বিষয়গুলো দেখভাল করে করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগ। বিভাগটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনার অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিষয়টি জড়িত। এরই মধ্যে ডেল্টা লাইফের আর্থিক বিভিন্ন ইস্যু সামনে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটির অন্তর্নিহিত আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ও ইতোমধ্যে আইডিআরএ ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি অবগত হয়েছে। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং আইনি লড়াইয়ের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির পক্ষ থেকে কোম্পানিটির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে বিভাগটির কর্মকর্তারা জানান।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি আইডিআরএর সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। সেদিন বিকালেই কোম্পানিটির কার্যালয়ে গিয়ে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আইডিআরএ কর্তৃক প্রশাসককে বেশকিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন পলিসি ইস্যুর পাশাপাশি কোম্পানিটির প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, আইডিআরএ কর্তৃক নির্বাচিত দুজন পরামর্শক নিয়োগ করা, দেশী কিংবা বিদেশী নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা। তাছাড়া প্রশাসককে দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মধ্যে আইডিআরএর কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর ডেল্টা লাইফের ব্যবসায়িক ও আর্থিক কার্যক্রম সচল রাখার পাশাপাশি কোম্পানিটির অ্যাকচুয়ারি ও আর্থিক নিরীক্ষা করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন প্রশাসক। তাছাড়া ডেল্টা লাইফ কর্তৃক আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির কারণে দুদকে দায়ের করা অভিযোগটি সম্প্রতি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্রশাসক।
প্রশাসক নিয়োগের জন্য ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে আইডিআরএ কর্তৃক কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়ার পর পরই কোম্পানির পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র নিরীক্ষার দাবিতে গত ২৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়। বিএসইসি কর্তৃক বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ডেল্টা লাইফের সাবেক পরিচালক জিয়াদ রহমান বলেন, স্বচ্ছতার স্বার্থে আমরা এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে এটি আইডিআরএ কর্তৃক প্রশাসক বসানোর আগেই করার প্রয়োজন ছিল। আমরা সরকারের কাছে আরজি জানাই যেন দ্রুততার সঙ্গে কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ চাওয়ার বিষয়ে ড. এম মোশাররফ হোসেনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ করা হোক। বীমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনার জন্য এটিই একমাত্র উপায়। পাশাপাশি বীমা খাতের অন্যান্য কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ ডেল্টা লাইফের সঙ্গে এগুলো করে ড. মোশাররফ যদি পার পেয়ে যান তাহলে ভবিষ্যতে এ খাতের অন্যান্য কোম্পানিকে এর শিকার হতে হবে।
প্রসঙ্গত, একদিকে ডেল্টা লাইফ কর্তৃক আইডিআরএর চেয়ার্যমানের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ, অন্যদিকে কোম্পানিটিতে আইডিআরএ কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগের পাশাপাশি দুই পক্ষই আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ডেল্টা লাইফ প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গিয়েছে। অন্যদিকে ঘুষ দেয়ার প্রস্তাবসহ মিথ্যা অপবাদ দেয়া ও কূটকৌশলের মাধ্যমে মানহানি করার প্রচেষ্টার কারণে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান ও তার মেয়ে কোম্পানিটির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমানসহ কোম্পানিটির আরো চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন। তাছাড়া সম্প্রতি ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার কারণে মামলা করা হয়েছে।