ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সময় আরও বাড়ানোর জন্য নতুন প্রস্তাব করেছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, কোনো ডাউনপেমেন্ট না দিয়ে চলমান সব ঋণ তিন বছর মেয়াদে পুনঃতফসিলের সুযোগ চান তারা। এছাড়া বিদ্যমান মেয়াদি ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাড়তি যে দুই বছর সময় দিয়েছে, তা তিন বছর করার দাবি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের বরাবরে গত বৃহস্পতিবার প্রেরিত এক চিঠিতে এই অনুরোধ করা হয়। এসব প্রস্তাব নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে জরুরি বৈঠকও করেছেন ব্যাংক মালিকরা। বৈঠকে তাদের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন গভর্নর।
বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, করোনার কারণে ঋণের কিস্তি যেগুলো অপরিশোধিত রয়েছে, সেটা একবারে ব্যবসায়ীদের পক্ষে দেয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। এজন্য আমরা ঋণ পরিশোধে কিছুটা শিথিল হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ করেছি। আমাদের যে কথাগুলো সেখানে বলা হয়েছে, সেটা যদি সেভাবে সমন্বয় করা হয় বা রিলাক্স করা হয় তাহলে সেটা সবার জন্যই ভালো হবে। বৈঠকে এটা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। গভর্নর এ বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রতিনিধিকে বলেন, বৈঠকে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংক মালিকরা যে অনুরোধ করেছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। কারণ তাদের প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই বেশি জড়িত।
দেশের অর্থনীতিতে করোনার বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে ২০২০ সালজুড়ে ছাড় দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে টানা এক বছর ঋণ পরিশোধ না করলেও কেউ খেলাপি হয়নি। তবে ২০২১ সালে এ সুবিধা আর বহাল রাখেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সম্প্রতি এক সার্কুলারে মেয়াদি ঋণের যে মেয়াদ বাকি আছে, তা পরিশোধের সময় সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা দুই বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এই সুবিধার আওতায় স্বল্প সময়ের মধ্যে সব ব্যবসায়ীর পক্ষে ঋণের টাকা শোধ করা দুষ্কর হবে বলে মনে করে বিএবি। তাই ওই সার্কুলারের সংশোধনসহ দুটি বিষয় বিবেচনার অনুরোধ করে গত বৃহস্পতিবার বিএবির পক্ষ থেকে গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখনও করোনার ভয়াবহ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আগের মতো না হলেও সংক্রমণ একেবারে শেষ হয়নি। বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়পড়তা ৫০ শতাংশ বা তারও নিচের সক্ষমতায় চলছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যাপকভাবে কমেছে। এতে ট্রেডিং তথা ব্যবসা খাতের প্রতিষ্ঠানের গড় বিক্রিতে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। ফলে তাদের দৈনন্দিন ব্যবসায়িক খরচ মিটিয়ে মুনাফা পর্যায়ে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার প্রকোপে সব রিটেইল বিক্রয় এ মুহূর্তে নিম্নগামী থাকায় এমন হয়েছে। এরকম অবস্থায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে ব্যবসায়ীরা যাতে বিদ্যমান ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারে, সে জন্য দুটি বিষয় বিবেচনার নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
প্রথমত. কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের ৫০ শতাংশ বা দুই বছর অতিরিক্ত সময় বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এতে যেসব ঋণের মেয়াদের পরিমাণ বেশি, তারা কিছুটা সুবিধা পাবে। কিন্তু যাদের অবশিষ্ট মেয়াদ খুবই কম, তাদের কম সময়ে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা খুবই দুষ্কর হবে। এতে ঋণের বড় অংশ অনিচ্ছাকৃত খেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকা প্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কমপক্ষে আরও তিন বছর বাড়ানোর সুপারিশ করছি। যাতে করে এ বিপর্যয়কালে ব্যবসায়ী মহল মহামারির ধকল সামলিয়ে সহনীয়ভাবে ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ পায়। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনায় চলতি মূলধন ও তলবি ঋণ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, যা এক বছরের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণ। এতে মোট ঋণের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নির্দেশনার বাইরে রয়ে গেছে। তাই ২০২০ সালের সব কিস্তি ও সুদ এখনই শোধ না হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এসব ঋণখেলাপি হয়ে যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। সে জন্য চলতি মূলধন ও তলবি ঋণের পরিশোধযোগ্য অংশ এককালীন কোনো জমা ছাড়াই মেয়াদি ঋণ হিসেবে তিন বছরে পরিশোধের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করছি।