রাষ্ট্রায়ত্ত দুই বিশেষায়িত ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন ধরে চলতি দায়িত্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দিয়ে চলছে। এ বছরের মাঝামাঝি নাগাদ মেয়াদ শেষ হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরো তিন ব্যাংকের এমডির। এ ছয় প্রতিষ্ঠানে এমডি নিয়োগ দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এমডি পদে নিয়োগ পেতে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের ২১ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গঠিত এ-সংক্রান্ত বাছাই কমিটি ভাইভা গ্রহণ করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এমডির মেয়াদ শেষ হওয়া তিন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন। আর এমডির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে যে তিন ব্যাংকের সেগুলো হলো আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভাকক্ষে ভাইভা দিতে বিভিন্ন ব্যাংকের ২১ ডিএমডি উপস্থিত হন। বাছাই কমিটির সদস্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম সভাকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অর্থমন্ত্রীসহ কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার অনলাইন প্লাটফর্মের মধ্যে ভাইভা পরীক্ষায় যুক্ত ছিলেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশেষায়িত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কার্যক্রম বেশ কিছুদিন থেকেই চলতি দায়িত্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে চলছে। এছাড়া আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডির মেয়াদ চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। তাই ছয় এমডি নিয়োগ দেয়ার জন্য ভাইভা গ্রহণ করা হয়েছে। ভাইভায় বিভিন্ন ব্যাংকের ২১ জন ডিএমডি অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্য থেকে তিনজনকে সরাসরি এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হবে। বাকি তিনজনকে প্যানেলে নিয়োগ দেয়া হবে। তিন ব্যাংকের এমডিদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ওইসব ব্যাংকে প্যানেলভুক্তরা যোগদান করবেন।
তিনি বলেন, এমডি নিয়োগে বাছাই কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী। তিনি বেশ কিছুদিন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন, তাছাড়া বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বাছাই কমিটির বৈঠক ডাকা সম্ভব হয়নি। তাই একসঙ্গে তিন ব্যাংকের এমডি পদ খালি হয়ে যায়। আগামীতে যেন আর কোনো ব্যাংকের এমডি পদ খালি না থাকে, সেজন্য অগ্রিম প্যানেল নিয়োগ দেয়া হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এমডি পদে নিয়োগ পেতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকের ২১ ডিএমডি ভাইভায় অংশ নেন। ভাইভা দেয়া ডিএমডিরা হলেন জনতা ব্যাংকের মো. ইসমাইল হোসেন, মো. জিকরুল হক, মো. জসীম উদ্দিন, মো. আব্দুল জাব্বার ও মো. আমিরুল হাসান। সোনালী ব্যাংকের মো. আফজাল করিম, মো. জাহিদুল হক, মো. আব্দুল মান্নান এবং মো. মুরশেদুল কবীর। রূপালী ব্যাংকের মো. জাহাঙ্গীর আলম, খন্দকার আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। অগ্রণী ব্যাংকের মো. আনিসুর রহমান, মো. রফিকুল ইসলাম ও মো. ওয়ালি উল্লাহ। বিডিবিএলের মো. কামাল হোসেন গাজী ও মো. রিফাত হাসান। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মো. এবনুজ জাহান, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শিরীন আখতার, কর্মসংস্থান ব্যাংকের মো. জামিনুর রহমান এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোহাম্মদ ইদ্রিছ।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘদিন এমডিহীন থাকা প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, এসব ক্ষেত্রে সময়মতো নিয়োগ দেয়া উচিত। প্রত্যেক দেশে এমডি অবসরে যাওয়ার দুই থেকে তিন মাস আগেই নতুন এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে একজন থাকেন ডেজিগনেট এমডি আর অন্যজন হচ্ছেন এমডি। যখন এমডি অবসর গ্রহণ করেন, তখন ডেজিগনেট এমডি কাজ বুঝে নেন। আমাদের দেশে এসব কালচার নেই।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে যেদিন এমডি অবসরে যাবেন সেদিন কিংবা তার পরে নতুন এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। এটা ভুল চর্চা। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা থাকে না। আগের জন্য ধারণার সঙ্গে পরের জন্য চিন্তা-ভাবনার যে একটা মিল রাখা সেটাও থাকে না। তাই এমডি নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে এসব বিবেচনা করে অবসরের কয়েক মাস আগেই নতুন এমডি নিয়োগের বিষয়ে নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
এদিকে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ বা পদোন্নতি ও পদায়ন-সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জারি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওই নীতিমালায় বলা হয়, সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক অথবা পদোন্নতির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়োগ বা পদায়ন সম্পন্ন করবে। এক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উপব্যবস্থাপনার পরিচালকদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হবে। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রদান ও পদায়ন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য জ্যেষ্ঠতা সংশ্লিষ্ট পদে তাদের নিয়মিতভাবে পদোন্নতি প্রদানের তারিখ থেকে গণনা করা হবে। কোনো কর্মচারীর পদোন্নতি প্রক্রিয়াধীন থাকাকালীন তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বৈদেশিক নিয়োগ, বিদেশে প্রশিক্ষণ, লিয়েনে কর্মরত থাকা ইত্যাদি কারণে অন্যত্র অবস্থান করলে তার পদোন্নতির বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক বিবেচনা করা হবে।
নীতিমালায় আরো বলা হয়, নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি সরকার ঘোষিত জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী (সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে সংশোধন কিংবা নতুনভাবে জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা সাপেক্ষ) বেতন ও ভাতাদি পাবেন। কর্মরত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিধি অনুযায়ী পেনশন বা গ্র্যাচুইটি, লিভ স্যালারি ও ভবিষ্য তহবিল, গোষ্ঠীবীমা ও অন্যান্য কল্যাণমূলক স্কিমের সুবিধাদি পাবেন।
পদত্যাগ, চাকরি থেকে অব্যাহতি ও অবসর গ্রহণ বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়, সরকারি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার আওতায় বা আদালতে কোনো মামলা মুলতবি না থাকলে বা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে কোনো আর্থিক দায়-দেনা না থাকলে এবং নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে তিন মাসের নোটিস প্রদান সাপেক্ষে অথবা তিন মাসের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ সমর্পণপূর্বক কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে পদত্যাগ করতে পারবেন। অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইন কার্যকর হবে। তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত হলে সেক্ষেত্রে চুক্তিতে বর্ণিত অনুরূপ শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে। আর অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪-এর বিধানাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবেন।