দেশের মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে। সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালে অন্যান্য খাতের পণ্যের তুলনায় গড়ে পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমেছে বেশি হারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে তৈরি দেশের পোশাকের রপ্তানি কমেছে ৫৭৩ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৫৬০ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা।
করোনা মহামারির সময় শিল্পের টিকে থাকার স্বার্থে সরকার বড় অঙ্কের প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণা করেছিল। এর শুরু হয়েছিল তৈরি পোশাকশিল্পকে দিয়ে। এ খাতের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য সামান্য সূদে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া চলতি মূলধন যোগানোর লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকেও ঋণ পেয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তবে অন্যান্য খাতের মতো অভিযোগ রয়েছে, এ খাতেও অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রণোদনার ঋণ নিতে পারেননি। আবার নামমাত্র সুদে শ্রমিকের বেতনের জন্য দেওয়া ঋণও সব কারখানা পায়নি। পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠনের সদস্যের বাইরে কোনো কারখানা এ ঋণের সুবিধা পাননি। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার শর্ত থাকায় অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। সব মিলিয়ে রপ্তানি কমে যাওয়া এবং প্রণোদনার সুবিধাবঞ্চিত তৈরি পোশাক খাতের ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য এখন দুর্দিন।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরই ঋণের প্রয়োজন ছিল বেশি। কিন্তু তাদের অনেকেই প্রণোদনার ঋণ পাননি। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার শর্ত থাকায় তাদের কাছে এ সুবিধা পৌঁছায়নি।
সূত্র জানায়, গত বছর পোশাকের দরও কমে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে নিটওয়্যার পণ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া ১২ ধরনের পোশাকের দর কমেছে আগের বছরের (২০১৯ সাল) তুলনায় ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর আট ধরনের ওভেন পোশাকের রপ্তানি মূল্য কমেছে গড়ে ১ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। তবে করোনা ভাইরাসের টিকা প্রয়োগ শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরছে। অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে রপ্তানির এ খারাপ পরিস্থিতি আগামী মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। সব মিলিয়ে এ বছরের দ্বিতীয় ভাগের আগে (জুন পর্যন্ত) খুব অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আশার কথা হলো, প্রধান রপ্তানি গন্তব্যের দেশগুলোতে টিকার প্রয়োগ শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।
বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান গন্তব্য ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানও পোশাক বড় বাজার। রপ্তানিকৃত পোশাকের ৮০ শতাংশের ওপরে যায় এসব দেশে। এর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হওয়ায় রপ্তানি আদেশেও প্রত্যাশিত গতি নেই বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, অতীতে বছরের এ সময়ে যে ক্রয়াদেশ থাকার কথা, এখন তা নেই। অন্যদিকে ওভেন পোশাক রপ্তানিকারকদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত বেশি খারাপ।
ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সব মিলিয়ে পোশাক রপ্তানি কমেছে আগের বছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এর মধ্যে করোনার শুরুর দিকে লকডাউনের কারণে রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে ব্যাপকভাবে। গত মার্চে পোশাক রপ্তানি কমেছিল ২০ শতাংশ, এপ্রিলে ৮৫ শতাংশ আর মে মাসে ৬২ শতাংশ। জুনে তা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসে (৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ)। জুলাইয়ে প্রায় দুই শতাংশ কমার পর আগস্ট ও সেপ্টম্বরে আড়াই ও তিন শতাংশ বেড়েছিল। তবে এর পরের মাসগুলোতে আবার কমতে শুরু করে। সর্বশেষ তিন মাস অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পোশাক রপ্তানি কমেছিল পৌনে আট শতাংশ, দুই দশমিক ৬৬ শতাংশ ও পৌনে ১০ শতাংশ।