পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানিটির সাম্প্রতিক ঋণ কেলেঙ্কারীর তথ্য প্রকাশের আলোকে কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে কোম্পানিটিতে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া শত শত কোটি টাকার ঋণ বের করে নিয়েছেন। আবার ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি) গাড়ি-বাড়ি কিনতে অনুমোদন ছাড়া ঋণ নিয়েছেন।
এর আলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সত্য উম্মোচনের জন্য বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এ বিষয়ে কমিশনের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, উত্তরা ফাইন্যান্স শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হিসেবে কোম্পানিটিতে সাধারন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। তাই সঠিক তথ্য বের করে আনার জন্য কমিশন বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এজন্য কমিশনের সংশ্লিষ্ট করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগকে (সিএফডি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান বিএসইসির ওই কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসলেও হঠাৎ ঋণ কেলেঙ্কারীতে আলোচনায় উঠে এসেছে উত্তরা ফাইন্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা বেশ কিছু লেনদেনের নথিপত্রও খুঁজে পায়নি, তাই সেসব লেনদেন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানিটির ২০১৯ ও ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে।
উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজারের মার্জিন ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এর মধ্যে ৩৫০ কোটি টাকা জমা হয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্সের বিভিন্ন পরিচালকের ব্যাংক হিসাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের আবেদন, প্রস্তাব বা অনুমোদন ছাড়া পরিচালকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমানতকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে ৩১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা উত্তরা ফাইন্যান্স পরিদর্শনে দেখেছেন, প্রতিষ্ঠানটির এমডি এস এম শামসুল আরেফিন কোনো অনুমোদন ছাড়াই ব্যবস্থাপনা ব্যয় শিরোনামে ২৪ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে এমডির পক্ষে সাউথ ব্রিজ হাউজিংকে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা, বে ডেভেলপমেন্টকে ১ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে ডিএইচএসকে ৫০ লাখ টাকা ও উত্তরা মোটরসকে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে উত্তরা মোটরস ও উত্তরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩৩৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যার কোনো অনুমোদন নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মুজিবুর রহমান ব্লু চিপস সিকিউরিটিজের কর্ণধার। এই প্রতিষ্ঠানের ২৩৬ কোটি টাকা আমানত জমা করা হয়েছে। তবে এর বিপরীতে কোনো বৈধ নথিপত্র সংরক্ষণ নেই। ফলে আদৌ এই টাকা জমা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। যদি কোনো ব্যাংক এই আমানতের বিপরীতে ঋণ দেয়, তার পুরো দায় উত্তরা ফাইন্যান্সের ওপর বর্তাবে।
উল্লেখ্য, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত উত্তরা ফাইন্যান্সের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৩১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এরমধ্যে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের মালিকানা ৪৪.৪৪ শতাংশ। বাকি ৫৫.৫৬ শতাংশ মালিকানা শেয়ারবাজারের বিভিন্ন শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের।