দীর্ঘ মন্দা ও করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু কার্যকর উদ্যোগের ফলে পতনমুখী প্রবণতা থেকে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, গত কয়েক বছরের মতোই চলতি বছরের শুরু থেকে শেয়ারবাজারের ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় করোনা মহামারির আঘাত। ঠিক ওই সময় টালমাটাল শেয়ারবাজারকে সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার জিরো টলারেন্স নীতিতে শেয়ারবাজার ছয় মাসে ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে।
দীর্ঘদিনের আস্থার সঙ্কট দূর করে শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা ছিল বিএসইসির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতায় বিএসইসি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিকলা করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে এর প্রমাণও মিলেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও গত আগস্টে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করে বিশ্বসেরা খেতাব পেয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ওই সময়ে পুঁজিবাজারে ১৫.৮০ শতাংশ উত্থান হয়েছে। পুনর্গঠিত বিএসইসির ওপর আস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা।
এদিকে, বিগত কমিশনের আমলে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল তলানিতে। চোখের সামনে বহু গুরুতর অনিয়ম হতে দেখেও তৎকালীন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেন তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। তবে বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামসহ অন্য কমিশনারদের দায়িত্ব গ্রহণের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে তাদের নেওয়া দৃঢ় পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পেয়েছেন। এতে শেয়ারবাজারে প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতনে সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই শুরু হয় করোনা মহামারি। ২৬ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় শেয়ারবাজার। ৬৬ দিন পর গত ৩১ মে ফের শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয়। ওই দিন লেনদেন শুরুর পর থেকে গত ৬ মাসে পর্যন্ত মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বেড়েছে সূচক ও লেনদেন। এ সময়ে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ১০০০ পয়েন্টের বেশি। ৩১ মে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪০৬০ পয়েন্টে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১২৩.০৬ পয়েন্টে। একইভাবে গত ৬ মাসে ডিএসই’র লেনদেন বেড়েছে ৮০০-৯০০ কোটি টাকার বেশি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনও বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, শেয়ারবাজার পরিচালনায় দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কমিশন সুশাসন ফেরাতে আইন সংস্কার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। দুর্বল ও লোকসানে থাকা কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রশাসক বসানো এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনেরও নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়া, শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জিরো টলারেন্স নীতিতে ফ্রিজ করেছে অনেক কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকদের বিও হিসেবে থাকা শেয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে অনেকের ব্যাংক হিসাব। এর বাইরেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়।
পাশাপাশি বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করে কর সুবিধা বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্তসহ সকল ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তাগিদ বৃদ্ধি করা, ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশ সেপ্টেম্বরের আগে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) শক্তিশালী করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করপোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করা, জেড ক্যাটাগরি কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, পুঁজিবাজারের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগ, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের সভার করার অনুমোদন, আইপিও প্রক্রিয়া সহজ করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ও বিদেশে ব্রোকার হাউজের শাখা খোলার অনুমোদন, শেয়ারবাজারকে ডিজিটালাইজ করাসহ আরও অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও সুশাসন ফেরানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দিয়ে পুঁজিবাজারের আইন-কানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীর জমানো মূলধন কেউ যেন খেয়ে ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে আস্থা বাড়ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশ্বাস পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে ফিরছেন।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। আইপিওর ক্ষেত্রে যত অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো ধরা হচ্ছে। কারসাজি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পরিচালকদের ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকা কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার কিনতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরেছে।’
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যদিও বিএসইসির জন্য এ বিষয়টি খুব চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। তবে যোগ্য নেতৃত্বের কারণে দীর্ঘদিনের আস্থার সঙ্কট দূর করে শেয়ারবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে এনেছে বিএসইসি। এতে শেয়ারবাজারের ওপর হারানো আস্থা ফিরে পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।’