দেশের অব্যাংকিং আর্থিক খাতের লিজিং কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমানত, তারল্য ও মুনাফা নিয়ে নিদারুণ সংকটের মধ্যে রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট তত বাড়ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদ ধরে রাখতে পারছে না। এর সঙ্গে মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি তারল্য সংকটের পরিমাণও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সংকট বাড়ায় ইতোমধ্যে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) অবসায়নের উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয়েছে। নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিংকে চলতি বছরের জুলাই মাসে অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। যদিও পিপলস লিজিংকে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের সঞ্চয় ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আমানতকারীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আর্থিক খাতের অন্য কোম্পানিগুলোর অবস্থার উন্নতি হয়নি। উল্টো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লোকসানের কবলে পড়েছে। মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় নয়টির মুনাফা কমে গেছে। পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ১৪টির। সম্পদের মূল্য কমে গেছে ১৫টির। এর মধ্যে একটির সম্পদের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
সার্বিকভাবে আমানত, তারল্য, মুনাফা, সম্পদের মূল্য- সব ক্ষেত্রেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকটের মাত্রা বেড়েছে। মুনাফা, সম্পদের মূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো- এ তিনটির এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ২০টি কোম্পানির। তিন সূচকের কোনোটিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের।
বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি লোকসানে নিমজ্জিত রয়েছে। এমনকি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে সম্পদের মূল্য। বাকিগুলোর মধ্যে লোকসানের পাশাপাশি সম্পদের মূল্য কমেছে আটটির। এর মধ্যে সাতটির অর্থ সংকটও আছে।
নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ২৩ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২টি চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ওই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। অবসায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
বে লিজিং, বিডি ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, ফারইষ্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, আইডিএলসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বে লিজিংয়ের শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকা ৬৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯ টাকা ৪২ পয়সা। বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৩৯ পয়সা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ১৬ টাকা ৭৭ পয়সা। বিআইএফসির ঋণাত্মক সম্পদ মূল্য ৭১ টাকা ৯৩ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ২৪ পয়সা।
ফারইষ্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ টাকা ১৪ পয়সায়, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৭ টাকা ২২ পয়সা। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি সম্পদ ৭ টাকা ৭২ পয়সা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ১০ পয়সায়। জিএসপি ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি সম্পদ ২২ টাকা ৮৪ পয়সা থেকে কমে ২২ টাকা ৩১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আইডিএলসির শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৩৬ টাকা ১৪ পয়সা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৩৬ টাকা ১৭ পয়সা।
বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লংকাবাংলার শেয়ারপ্রতি সম্পদ ১৯ টাকা ১৪ পয়সা থেকে কমে ১৮ টাকা ৬ পয়সা, মাইডাস ফাইন্যান্সের ১০ টাকা ৭১ পয়সা থেকে কমে ৯ টাকা ৫৭ পয়সা, ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ১৩ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে কমে ১২ টাকা ২ পয়সা, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ১৬ টাকা ৬৭ পয়সা থেকে কমে ১৬ টাকা ৬২ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছরের জুন থেকে সম্পদের মূল্য কমার তালিকায় রয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শেয়ারপ্রতি সম্পদ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ১৩ টাকা ৪৬ পয়সা থেকে কমে ১২ টাকা ৮৩ পয়সা, আইপিডিসির ১৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে কমে ১৫ টাকা ৪৫ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ১৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে কমে ১৮ টাকা ৪৬ পয়সা এবং আইসিবির ৪৪ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে কমে ২৭ টাকা ১৩ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভলো নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থা নেই। ফলে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। আবার বিতরণ ঋণের বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে। যে কারণে তারল্য সংকটে পড়ে অনেকে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। সার্বিকভাবে তারল্য ও মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় কোম্পানির সম্পদের মূল্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে কোম্পানিগুলোকে প্রভিশন করতে হচ্ছে। এতে কোম্পানির নেট লস (লোকসান) হচ্ছে। নেট লস হলে ইক্যুইটি হ্রাস পায়। এজন্য এনএভি (প্রকৃত সম্পদ মূল্য) হ্রাস পেয়েছে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং গ্রাহকের আমানত না পাওয়ার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ চিত্র। প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ নির্ভর করে লোনের ওপর। তারা তো আমানত পাচ্ছে না। আমানত না পেলে লোন দেবে কীভাবে? এছাড়া প্রফিট (মুনাফা) যদি নেগেটিভ হয়, তাহলে তো ভ্যালু কমে যাবেই।
চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে লোকসানের মধ্যে পাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে- বিডি ফাইন্যান্স ৯ পয়সা, বিআইএফসি ১ টাকা ১ পয়সা, ফারইষ্ট ফাইন্যান্স ২ টাকা ৬৩ পয়সা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ১ টাকা ১৩ পয়সা, লংকাবাংলা ১ পয়সা, মাইডাস ফাইন্যান্স ৩২ পয়সা, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ১ টাকা ৩৭ পয়সা এবং আইসিবি ১ টাকা ৯৩ পয়সা শেয়ারপ্রতি লোকসানে আছে। এর মধ্যে লংকাবাংলা, ফারইষ্ট ও বিআইএফসি আগের বছরেও লোকসানে ছিল। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি বছরে নতুন করে লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে।
ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে- আইসিবি ৫ টাকা ১৮ পয়সা, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ১ টাকা ১০ পয়সা, প্রাইম ফাইন্যান্স ৮ পয়সা, প্রিমিয়ার লিজিং ১ টাকা ৩৭ পয়সা, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স ২৫ টাকা ৮৩ পয়সা, মাইডাস ফাইন্যান্স ২ টাকা ২০ পয়সা, লংকাবাংলা ৭ টাকা ১ পয়সা, ইসলামীক ফাইন্যান্স ৯ টাকা ৬২ পয়সা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৬ টাকা ৬১ পয়সা, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৯ টাকা ১৫ পয়সা, ফাস ফাইন্যান্স ৯ টাকা ৪৮ পয়সা, ফারইষ্ট ফাইন্যান্স ৮১ পয়সা, বিআইএফসি ১ টাকা ৭ পয়সা এবং বিডি ফাইন্যান্স ২৭ পয়সা শেয়ারপ্রতি ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লোতে আছে।
ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সংকটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হতে পারে। এতে খরচ বেড়ে যায় এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়ার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ঋণাত্মক ক্যাশ ফ্লো হওয়ায় তারা বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছেন না। এছাড়া মানুষ এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাসও করতে পারছেন না, যে কারণে তারা আমানত রাখছেন না। অনেকে আমানত তুলে নিচ্ছেন। এ কারণে ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
আর্থিক খাতের এ দুরবস্থা থেকে উঠে আসার উপায় হিসেবে এ বিশ্লেষক বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে যারা কারচুপি বা দুর্নীতি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি ম্যানেজমেন্টের লোক হোক বা বোর্ডের লোক হোক, সবাইকে আইনের মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে খারাপ ঋণগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। মোট কথা, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন না থাকায় আর্থিক খাতগুলো এ সংকটে পড়েছে।
অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় থাকলেও ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ) ও উত্তরা ফাইন্যান্সের মুনাফার পাশাপাশি সম্পদের মূল্য বেড়েছে এবং ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্স জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২ টাকা ৬৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ২৩ পয়সা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬১ টাকা ৩৩ পয়সা, যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫৫ টাকা।
শেয়ারবার্তা / আনিস