পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রায় ছয় হাজার আমানতকারীর সঞ্চয় ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ৬ নভেম্বর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রায় ছয় হাজার আমানতকারীর সঞ্চয় ফেরত প্রদানে নির্দেশক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করা হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টাতে আরও একটু জানতে হবে আমায়। এ বিষয়ে কোর্ট-কাচারি হয়ে গেছে, সেক্ষেত্রে কোর্টের নির্দেশনাও একটা ফ্যাক্টর। আমানতকারী হয়তো অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ধরনের একটা চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নেয়ার জন্যই চিঠিটা পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় যখন এ ধরনের একটা চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে, তখন সেটা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। কিন্তু বিষয়টা যখন কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় তখন বাংলাদেশ ব্যাংক কতটুকু করতে পারে- সেটাও চিন্তার বিষয়।’
এদিকে পিপলস লিজিং অবসায়ন হলেও আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন বলে আশ্বস্ত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১০ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলেছিলেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় চরম সংকটে থাকা ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল) অবসায়নের (লিকুইডেশন) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে আমানতকারীদের কোনো সমস্যা হবে না। তারা তাদের টাকা ফেরত পাবেন। কারণ পিপলস লিজিংয়ের আমানতের চেয়ে সম্পদের পরিমাণ বেশি আছে- এমনটা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেছিলেন, ২০১৪ সালে তদন্ত করে পিপলস লিজিংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য জানতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তদন্তে পরিচালনা বোর্ডের অনেক সদস্যের অনিয়ম পাওয়া যায়। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে পরিচালনা বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড গঠন করে। একই সঙ্গে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
‘কিন্তু এত কিছুর পরও প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেই। ২৬ জুন মন্ত্রণালয় অবসায়ন করতে অনুমতি দেয়। পরে অবসায়নের জন্য আদালতে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
অবসায়ন হলেও আমানতকারীদের আতঙ্কের কিছু নেই উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সেসময় বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যে হিসাব রয়েছে তাতে প্রতিষ্ঠানটির আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে আমানত দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে তিন হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।’
আমানতকারীরা কতদিনের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত পাবেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে সিরাজুল ইসলাম বলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়ার পর থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দ্রুত আমরা এ কার্যক্রম সম্পন্ন করব। তবে যেহেতু আমরা আদালতে যাচ্ছি, এটা এখন আদালতের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আমানতকারীদের অর্থ যত দ্রুত সম্ভব দেয়ার চেষ্টা করব।
আমানতকারীদের শতভাগ অর্থ ফেরত দেয়া হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি সেসময় বলেন, এটাও সিদ্ধান্ত নেবেন আদালত।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আশ্বস্তের চার মাস পার হলেও অর্থ ফেরত পাননি আমানতকারীরা। তাই অর্থ ফেরত পেতে ‘পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আমানতকারীদের কাউন্সিল’ এর ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে তারা জানান, অর্থমন্ত্রী আমানতকারীদের টাকা দ্রুত ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
সাক্ষাৎ শেষে পিএলএফএসের পক্ষে আতিকুর রহমান আতিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘পিপলস লিজিংয়ের ক্ষুদ্র আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ রেখে এখন তা ফেরত না পেয়ে চরম অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন। তারা কোথায় গেলে এ টাকা ফেরত পাবেন, সেটার কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় হাজারও আমানতকারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। এ টাকা থেকে অনেক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের সংসারের ব্যয় নির্বাহ হতো। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও চিকিৎসা খরচ চলত। কিন্তু এখন সব বন্ধ রয়েছে।’
গত ৯ নভেম্বর গুলশানের একটি হোটেলে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-কে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের সঞ্চয় ফেরত দেয়ার দাবি জানান আমানতকারীরা। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনটি দাবি জানান কাউন্সিলের প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিক।
দাবিগুলো হলো-
১. পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-কে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন (রি-কনস্ট্রাকশন) অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তি আমানতকারীদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় দ্রুত ফেরত দেয়া।
২. চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যক্তি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. অবিলম্বে পিপলস লিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া। বিশেষ করে তারা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তাদের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা, তাদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফসিএল)- এর দায়দেনা হিসাব করতে একটি অডিট ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ফার্ম ‘একনাবিন’-কে পিপলস লিজিংয়ের গত চার বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ‘একনাবিন’ নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে। নিরীক্ষা শেষে পিপলস লিজিংয়ের পাওনা টাকা আদায় এবং আদালতের নির্দেশ-সাপেক্ষে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করা শুরু হবে।
শেয়ারবার্তা / আনিস