চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে মহামারি ভাইরাসের থাবায় থমকে দাঁড়িয়েছিল দেশের অর্থনীতি। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছিল স্থবিরতা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও বেশ ভালো ব্যবসা করেছে তালিকাভুক্ত বেশকিছু সাধারণ বীমা কোম্পানি। অবশ্য যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করেছে, তার থেকে বেশি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে দুই মাসের বেশি সময় সবকিছু বন্ধ ছিল। নতুন বিনিয়োগ হয়নি। আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবকিছু মিলিয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তবে মহামারির মধ্যেও সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর কমিশন নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও আগের বছরের তুলনায় কিছু প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বেড়েছে।
তারা বলছেন, আগে গ্রাহক টানার জন্য সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলো ইচ্ছামাফিক কমিশন দিত। কোনো কোনো কোম্পানি ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দেয়। যা কোম্পানির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে চলতি বছর থেকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কঠোর পদক্ষেপের কারণে কমিশন নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধ হয়েছে। কেউ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্ধারিত ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন দিচ্ছে না। ফলে বীমা পলিসি বিক্রি কমলেও কোম্পানির মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫টি সাধারণ বীমা কোম্পানির মধ্যে ৩৩টির চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বেড়েছে ১৫টির। বিপরীতে মুনাফা কমেছে ১৮টির। মুনাফায় মিশ্র প্রভাব থাকলেও চলতি বছরের প্রথমার্ধের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, এ সময়ে একটি কোম্পানিও নগদ অর্থ সংকটে পড়েনি। বরং গত বছর নগদ অর্থ সংকটে পড়া চারটি প্রতিষ্ঠান সংকট থেকে বেরিয়ে এসেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ৩৩টি সাধারণ বীমা কোম্পানি চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিক শেষে জানুয়ারি-জুন সময়ের প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।
নিয়ম অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জেও পাঠিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে গ্লোবাল ও রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স এখনও চলতি বছরের কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে বা প্রথম ছয় মাসে সবচেয়ে ভালো মুনাফা করেছে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৪ টাকা ২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ৫১ পয়সা।
মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধির দিক থেকে এর পরেই রয়েছে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ৭১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯১ পয়সা। মুনাফায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রগতী ইন্স্যুরেন্সেরও। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বেড়ে ২ টাকা ৫ পয়সা হয়েছে।
মুনাফা বাড়া কোম্পানিগুলোর চিত্র :
কোম্পানির নাম | শেয়ারপ্রতি মুনাফা | শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য | শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো | |||
২০২০ জানুয়ারি-জুন | ২০১৯জানুয়ারি-জুন | ২০২০জুন | ২০১৯জুন | ২০২০ জানুয়ারি-মার্চ | ২০১৯জানুয়ারি-মার্চ | |
এশিয়া ইন্স্যুরেন্স | ১.০৩ | .৯৪ | ২০.৪৮ | ১৯.৯১ | ২.৩৮ | ১.৪২ |
এশিয়া প্যাসেফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স | ১.৫১ | ১.২৮ | ২১.১৭ | ১৯.২৪ | ১.৭১ | .৬৪ |
ঢাকা ইন্স্যুরেন্স | ১.১০ | ১.০২ | ৩১.০৬ | ৩০.১৩ | ২০.৪৩ | ১৯.৪৯ |
ইষ্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স | ১.৫৭ | ১.৫৬ | ৪৫.৯৮ | ৪৪.৫৪ | .১৩ | .৭৫ |
ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স | .৪২ | .৩৭ | ১২.০০ | ১১.৫৭ | .৬১ | .৫১ |
গ্রীন ডেল্টা | ১.৬৩ | ১.২৪ | ৭০.৪৩ | ৬৮.৩৩ | ১.৪৪ | ১.৫২ |
জনতা ইন্স্যুরেন্স | .৭০ | .৪৭ | ১৪.৯১ | ১৪.২২ | ১.৪৭ | .৫৫ |
কর্ণফুলী | .৬৩ | .৬০ | ১৮.৮৫ | ১৮.২৯ | ১.৫৮ | .৫০ |
নিটল | ১.৫৫ | ১.৫১ | ২৭.৪৪ | ২৪.১৮ | .৭১ | ২.০৭ |
পাইওনিয়ার | ৪.০২ | ২.৫১ | ৪৬.২৩ | ৪৪.০৯ | ৩.৪৩ | ৩.৫৬ |
প্রগতী | ২.০৫ | ১.৪২ | ৫১.৮৯ | ৫০.৬৩ | ৪.৫৬ | ১.১২ |
প্রভাতী | ১.০৯ | .৯৪ | ২০.০৪ | ১৮.৫০ | ১.৮৭ | (১.২৪) |
পূরবী জেনারেল | .৬৭ | .৫১ | ১৩.৫৬ | ১৩.৫৮ | ১.২৮ | .১২ |
সোনার বাংলা | ১.৭১ | .৯১ | ২০.৩৩ | ১৮.৫৬ | .৭৪ | .৬৭ |
তাকাফুল | .৬৬ | .৫৪ | ১৭.৮৯ | ১৭.২৩ | ১.৬৪ | .৭১ |
এদিকে মহামারির মধ্যেও ভালো মুনাফা করার বিষয়ে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কিউ এ এফ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ভালো ব্যবসা হওয়ার কারণ, বাজারে আমাদের একটা সুনাম আছে। যে কারণে করোনা মহামারির মধ্যেও আমাদের ব্যবসা গত বছরের তুলনায় কমেনি। আমরা আগের বছরের ব্যবসা ধরে রাখতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘মুনাফা বাড়ার আর একটি বড় কারণ, কমিশন হার। এখন কমিশনের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কেউ ১৫ শতাংশের বেশি কমিশন দিতে পারছে না। অথচ আমাদের মতো কোম্পানিকে আগে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে।
সুতরাং এখন কমিশন দেয়ার পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমে গেছে। ফলে নতুন ব্যবসা কিছু কমলেও মুনাফার পরিমাণ বেড়েছে।’
এদিকে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের মুনাফায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসায়। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা কমে গত বছরের অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৭ পয়সা।
এরপর রয়েছে সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স। চলতি বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬২ পয়সা। মুনাফা কমে অর্ধেকের নিচে নেমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ও মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স।
গত বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৩৩ পয়সা মুনাফা করা ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স চলতি বছরে মাত্র ৫৪ পয়সা মুনাফা করেছে। প্রাইম ইন্স্যুরেন্স শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩১ পয়সা, যা গত বছর ছিল ৬৪ পয়সা। মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৮০ পয়সা থেকে কমে ৪০ পয়সায় নেমেছে।
মুনাফা কমা কোম্পানিগুলোর চিত্র-
কোম্পানির নাম | শেয়ারপ্রতি মুনাফা | শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য | শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো | |||
২০২০ জানুয়ারি-জুন | ২০১৯জানুয়ারি-জুন | ২০২০জুন | ২০১৯জুন | ২০২০ জানুয়ারি-মার্চ | ২০১৯জানুয়ারি-মার্চ | |
অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স | .৪৫ | .৭০ | ১৭.৪৮ | ১৭.৩৯ | .৭০ | (.৬৯) |
বিজিআইসি | .৯২ | .৯৯ | ১৯.২৩ | ২৫.৯৯ | ২.৩৬ | ১.৩৯ |
বাংলাদেশ ন্যাশনাল | .৭৫ | .৯৩ | ১৯.৮০ | ১৯.০৫ | ২.২৭ | (.০৭) |
সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স | .৯৫ | ১.০৩ | ২৫.৬৩ | ২৪.৬৮ | ১.২১ | ১.১৩ |
সিটি জেনারেল | .২৫ | .৬২ | ১৫.৯৩ | ১৫.৬৮ | .৫৩ | .১৭ |
কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স | ১.০৯ | ১.৯২ | ২০.৭১ | ১৯.৯৩ | .৭২ | .৫৪ |
ইষ্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স | .৭৬ | .৯০ | ১৯.৭৮ | ২০.১২ | .২৩ | .২৪ |
ইসলামী ইন্স্যুরেন্স | .৭৮ | .৮০ | ১৫.৬৩ | ১৪.৮৫ | ২.৪৬ | ১.২৬ |
মার্কেন্টাইল | .৪০ | .৮০ | ১৮.৭০ | ১৮.২৭ | .৩৬ | .৫২ |
নর্দান জেনারেল | .৮১ | ১.০৩ | ২০.৩০ | ১৮.৮০ | ৩.৩৬ | .৬১ |
প্যারামাউন্ট | .৩২ | .৮৭ | ২১.৯৮ | ১৩.৬৯ | ২.০১ | .৭০ |
পিপলস | .৮১ | .৮৫ | ২৭.৯৫ | ২৬.৭২ | .৮৮ | (.২৪) |
ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স | .৮৩ | ১.০৯ | ৩৬.০৪ | ৩৫.৯৩ | .৫৪ | .৯৪ |
প্রাইম ইন্স্যুরেন্স | .৩১ | .৬৪ | ১৬.০০ | ১৬.৩১ | ১.৬০ | ১.২০ |
রিলায়েন্স | ২.৪৯ | ২.৬৯ | ৫১.১২ | ৫২.৬০ | ৪.৫৬ | ৪.০৬ |
রূপালী | .৯৫ | ১.১৭ | ২১.৭৯ | ২১.০৬ | .৬০ | .৮৭ |
স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স | ১.০৭ | ১.১৬ | ১৯.০৯ | ১৮.০২ | .৬১ | .৯৫ |
ইউনাইটেড | .৫৪ | ১.৩৩ | ২৮.৪১ | ৩১.৮৭ | .৫৩ | .০১ |
মুনাফা কমে যাওয়ার বিষয়ে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, ‘করোনার কারণে মুনাফা কমে গেছে। এখনও আমরা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। মানুষ এখন জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য কোনো খাতে তেমন খরচ করছে না।
আবার আমদানি কমে গেছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আয় কমেছে। এপ্রিল-মে এই দুই মাস আমাদের কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। টিকে থাকাই এ সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আশা করি, বছরের শেষ ছয় মাসে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে।’
এছাড়া সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি ও সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রকোপ আমাদের ব্যবসায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এরপরও কিছু কোম্পানির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে কমিশন হার। ১৫ শতাংশ কমিশনের বিষয়ে আইডিআরএ কঠোর অবস্থা নিয়েছে। যে কারণে এখন কেউ বেশি কমিশন দিতে পারছে না। ফলে কোম্পানির খরচ কমছে এবং মুনাফাও বাড়ছে।’