সিগারেট জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি পণ্য। কিন্তু এটি অবৈধ পণ্য নয়। ফলে বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পণ্যটির বাজার বড় হয়েই চলেছে। তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো আইনি পদক্ষেপ তেমন কার্যকর হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর বাজার সম্প্রসারণ হওয়ায় সিগারেট কোম্পানিগুলোর মুনাফাও বাড়ছে ব্যাপকহারে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসার চেয়েও সিগারেটে মুনাফা অধিক বলেই মনে হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) মুনাফার চিত্র দেখে।
২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র আট বছরেই কোম্পানিটির নিট মুনাফা বেড়েছে প্রায় চার গুণ। মূলত কর কাঠামোর দুর্বলতার কারণেই সিগারেট কোম্পানি ব্যাপক হারে লাভবান হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কোম্পানিটির বিভিন্ন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মুনাফা বৃদ্ধির এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএটিবির ২০১১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ওই বছর তাদের নিট মুনাফা ছিল ২৫৫ কোটি ৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা। আর ২০১৮ সালে তা উন্নীত হয় এক হাজার এক কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র আট বছরের ব্যবধানেই কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে প্রায় চারগুণ। অন্য কোনো পণ্য বা সেবার ব্যবসায় এত দ্রুত মুনাফা চারগুণ হয়ে পড়ার নজির বিরল বলে মনে করেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২ সালে তাদের মুনাফা ছিল ৩৯৪ কোটি ১৬ লাখ ৪০ টাকা। এর পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯২ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। ২০১৪ সালে এক লাফে এ মুনাফা ৬২৮ কোটি ২০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৫ সালে মুনাফার পরিমাণ কিছু কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এরপরের বছর তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫৮ কোটি ২০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৭ সাল শেষে কোম্পানিটির নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৮৩ কোটি টাকায়। আর ২০১৮ সালে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা ছিল এক হাজার এক কোটি ২০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
মূলত দেশে বিদ্যমান শুল্ক ও কর কাঠামোর দুর্বলতার কারণে তামাক কোম্পানির মুনাফা দ্রুতগতিতে বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর এ শুল্ক ও কর নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সিগারেটের দাম এবং এর ওপর কর ব্যাপকহারে বাড়ানো হয়নি। ফলে পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এ কারণে পণ্যটির ভোগ বাড়ছে। আর ভোগ বাড়লে তো কোম্পানির মুনাফা বাড়বে এটিই স্বাভাবিক।’
শুল্ক-কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কি? এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, নানামুখী জটিলতা আছে। তামাকপণ্যের কর হারে বড় পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া শুরু হলে তা থামানোর জন্য রাষ্ট্রের নানা প্রান্ত থেকে তদবির করা হয়। এমনকি সংসদ সদস্যরা উচ্চ কর আরোপ না করার দাবিতে আধা সরকারি পত্র পাঠান। তাছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে এখনও সরকারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার রয়েছে। এসব বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক খাতে যৌক্তিক করারোপের বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো যেহেতু মোটা অংকের কর দেয়, ফলে সরকার তাদের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় থাকে। এ বিষয়টিও কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এদিকে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ সিগারেট কোম্পানিগুলোর ব্যবসা করার জন্য একটি উর্বর ভূমিতে রূপ নিয়েছে। তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেসব উদ্যোগ তেমন ফলদায়ক হচ্ছে না বলেই মনে করেন তারা। পাশাপাশি সরকার নীতিগতভাবে সিগারেটসহ অন্যান্য তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণে নানা প্রতিশ্রুতির কথা বললেও বাস্তবে সরকারের কর কাঠামোয় তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না বলে তারা মনে করেন। আর তামাকপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে এটির ব্যবহারের ফলে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য করনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সাধারণভাবে বলা হয় যে, তামাক কোম্পানি অনেক বড় অঙ্কের রাজস্ব দেয়। কিন্তু তামাকপণ্য ব্যবহারের ফলে দেশের জনগণের যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়, তার চিকিৎসায় এ খাত থেকে প্রাপ্ত মোট শুল্ক-করের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় হয়।’
তিনি বলেন, তামাক কোম্পানির মূল লক্ষ্য থাকে তরুণ শ্রেণির ভোক্তা তৈরি করা। ফলে তারা চায় পণ্যটির দাম এমন স্তরে থাকুক, যাতে তা কম আয়ের মানুষ ও তরুণদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। আর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় তরুণরা অনেকেই সিগারেটে আসক্ত হয়ে উঠছেন। ফলে তাদের বিক্রি বাড়ছে। এ মুনাফা বৃদ্ধির পেছনে মূলত ত্রুটিপূর্ণ করকাঠামোই দায়ী। তামাকের বিদ্যমান কর কাঠামো পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।