মহামারি প্রকোপ চললেও আতঙ্ক দূরে ঠেলে স্বাভাবিক হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। দেখা মিলছে বড় উত্থানের। একই সঙ্গে গতি বাড়ছে লেনদেনেও। এদিকে মহামারি করোনার ধাক্কায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। গেল ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৩৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে উল্টো চিত্র পুঁজিবাজারে। একই সময় পুঁজিবাজরে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬১ শতাংশ।
সূত্র মতে, বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তনের। গত ১৪ মে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান প্রফেসর এম খায়রুল হোসেনের মেয়াদ শেষ হয়। আর তার স্থলাভিষিক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডীন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
বিএসইসি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে খারাপ আইপিও তালিকাভুক্ত হবে না বলেও বিনিয়োগকারীদের অভয় দিয়েছেন। এছাড়াও বিএসইসি’র নানামুখী পদক্ষেপে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়তে শুরু করেছে। তারা আবারও বড় প্রত্যাশা নিয়ে পুঁজিবাজারে ফিরতে শুরু করেছে।
ঈদের পর গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে চার কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে। এতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ফিরে পেয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ঈদের আগের শেষ সপ্তাহেও মোটা অঙ্কের অর্থ ফিরে আসে শেয়ারবাজারে। ফলে দুই সপ্তাহে শেয়ারবাজারে ফিরেছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে এ অর্থ পুঁজিবাজারে ফিরেছে।
বড় অঙ্কের অর্থ ফেরার সপ্তাহে বেড়েছে সবকটি মূল্য সূচক। সেই সঙ্গে লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পাশাপাশি লেনদেনে অংশ নেয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ২৬০ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ৪২টির। আর ৫৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
এতে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৩৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল তিন লাখ ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে সাত হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা।
তার আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন বাড়ে আট হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই সপ্তাহে টানা উত্থানে বাজার মূলধন বাড়ল ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। বাজার মূলধন বাড়ার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের পরিমাণ সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে।
এদিকে গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ১৫০ দশমিক ৪০ পয়েন্ট। এর মাধ্যমে টানা সাত সপ্তাহ সূচকটি বাড়ল। এই উত্থানে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ৪০২ পয়েন্ট।
প্রধান মূল্য সূচকের পাশাপাশি গত সপ্তাহে বেড়েছে ডিএসইর শরিয়াহ্ সূচক। শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত এ সূচকটি গত সপ্তাহে বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৬১ পয়েন্ট। এ সূচকটিও টানা সাত সপ্তাহ বাড়ল।
বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইর আর একটি সূচক ডিএসই-৩০। এ সূচকটি গত সপ্তাহে বেড়েছে ৫৫ দশমিক ২৪ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে সূচকটি বাড়ে ৪৬ দশমিক শ‚ন্য ৫ পয়েন্ট এবং তার আগের সপ্তাহে বাড়ে ৫ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট।
এদিকে আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৭২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৪৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন বেড়েছে ২৭৯ কোটি ২২ লাখ টাকা বা ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আর গত সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৯০৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় দুই হাজার ২৩৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন বেড়েছে ৬৭০ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
গত সপ্তাহে ডিএসইর মোট লেনদেনে ‘এ’ গ্রুপে বা ভালো কোম্পানির অবদান ছিল ৮৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া ‘বি’ গ্রুপের অবদান ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ‘জেড’ গ্রুপের ১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ‘এন’ গ্রুপের দশমিক ৫৯ শতাংশ অবদান ছিল।
গত সপ্তাহে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ১০ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো, গ্রামীণফোন, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ভিএফএস থ্রেড ডাইং এবং সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
এদিকে করোনার প্রভাবে বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব নেই পুঁজিবাজারে। দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-জুন সময়ের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট) ওপর করা হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতিতে চলছে মন্দাভাব। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়লে দেশে সার্বিক বিনিয়োগ বাড়বে না। তাই মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে যেকোনো মূল্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গেল অর্থবছরে দেশে এফডিআই এসেছে ৩১৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার, এর মধ্যে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ১৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের চেয়ে এফডিআই কমেছে ৩৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ও নিট কমেছে ৩১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) এফডিআই এসেছিল ৪৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং নিট এফডিআই এসেছিল ২৬২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।