পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালের ৩ জুন করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড প্রণয়ন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিএসইসি’র প্রণীত এই কোড পরিপালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত কোম্পানিই এই কোড পরিপালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কোড বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ফ্যামিলি গভর্ন্যান্স। যতদিন কোম্পানিগুলো ফ্যামিলি গভর্ন্যান্স থেকে বের হতে না পারবে ততদিন করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডের বাস্তবায়ন শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে।
অবশ্য এই কোড প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাংক-বীমা সেক্টর এবং গ্রুপ অব কোম্পানিজ বলে প্রচারিত বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সংশোধনের দাবি উঠেছে। ব্যাংক-বীমা সেক্টরের এই কোড বাস্তবায়নের মূল সমস্যা স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পরিচালক। অন্যদিকে গ্রুপ অব কোম্পানিজের এই কোড বাস্তবায়নে হরেক রকম সমস্যা উঠে এসেছে।
বিএসইসি’র কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুযায়ী, প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সংখ্যা ন্যুনতম ৫ জন এবং সর্বোচ্চ ২০ জন। এছাড়া প্রতি ৫ জন পরিচালকের একজন স্বাধীন পরিচালক রাখার বিধান করা হয়েছে। অন্যদিকে বীমা আইনে পরিচালকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ জন রাখার কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে ১২ জন স্পন্সর ডিরেক্টর, ৬ জন পাবলিক শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এবং ২ জন স্বাধীন পরিচালক রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১৫ (৯) ধারায় তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ কোন ব্যাংক-কোম্পানীতে সর্বোচ্চ ২০ (বিশ) জনের কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ যদি কোনো বীমা কোম্পানির ২০ জন পরিচালক হয় তাহলে বিএসইসির কোড অনুযায়ী ৪ জন স্বাধীন পরিচালক রাখতে হবে। অন্যদিকে আইডিআরএ’র আইন অনুযায়ী দুই জন স্বাধীন পরিচালক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ জন রাখার বিধান রয়েছে। তাই তালিকাভুক্ত ব্যাংক-বীমা কোম্পানিগুলো তাদের প্রাইমারি রেগুলেটরদের বিধান মানবে নাকি বিএসইসি’র আইন পরিপালন করবে এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
যদিও ইতিমধ্যে এই সংশয়ের সমাধান কমিশন থেকেই দেওয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিক কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বিএসইসির কমিশনার বা দায়িত্বরত কর্মকর্তা উত্তরে বলেছেন, এই কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড প্রণীত হয়েছে ২সিসি আইন ধারা। আর ২সিসি আইনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অন্য যেকোনো আইনে যাই থাকুন না কেন ২সিসি আইনের আওতায় যে নির্দেশনা দেওয়া হবে তাই পরিপালন করতে হবে। তাই অন্য কোনো রেগুলেটরের আইন এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
যেহেতু ২সিসি আইন একমাত্র বিএসইসিকেই দেওয়া হয়েছে। তাই ক্যাপিটাল মার্কেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলকে এই আইন পরিপালন করতে হবে। অন্য কোনো রেগুলেটরের আইনে যাই থাকুন না কেন তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিকেই এই কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড পরিপালন করতে হবে।
স্বতন্ত্র বা স্বাধীন পরিচালকের কোটা পূরণ এবং স্বাধীন পরিচালক কতটুকু স্বাধীনভাবে মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারছে নাকি শুধু বোর্ডে মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে চা-বিস্কুট আর সম্মানী নিয়ে চলে আসছে সেটি দেখার সময় এসেছে।
করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডে এক তালিকাভুক্ত কোম্পানির এমডি/সিইও অন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির একই পদে না থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া এমডি/সিইও, সিএফও, এইচআইএসি এবং সিএস পদ আলাদা ব্যক্তি হওয়ার পাশাপাশি এই চার পদের ব্যক্তিরা একই সময়ে অন্য কোনো কোম্পানির কোনো এক্সিকিউটিভ পদ ধরে না রাখার নির্দেশনা রয়েছে। কমিশনের এই নির্দেশনা পরিপালনে বেশিরভাগ কোম্পানিরই আপত্তি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর যুক্তি, যেখানে একই গ্রুপের আন্ডারে এতোগুলো কোম্পানি রয়েছে সেখানে সব আলাদা আলাদা ব্যক্তি রাখা হলে কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, কোম্পানি আইনে গ্রুপ অব কোম্পানি বলে কিছু নেই। সব কোম্পানিই তার নিজস্ব আলাদা আইডেন্টিটি নিয়ে চলে। এমনকি পাবলিক লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে পর্যন্ত ডিমড্ পাবলিক কোম্পানি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। তাই কোনো ব্যক্তির গ্রুপ এমডি, গ্রুপ সিএফও, গ্রুপ সিএস বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি কোম্পানির জন্য টপ এক্সিকিউটিভদের আলাদা ব্যক্তি হওয়াই শ্রেয়। এতে কোম্পানির স্বচ্ছতা ও পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বলা হয়ে থাকে, ভালো করপোরেট গভর্ন্যান্সের চারটি পিলার রয়েছে। ০১. অ্যাকাউন্টেবিলিটি (দায়) ০২. ফেয়ারনেস (সততা) ০৩. ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা) এবং ০৪. রেসপনসিবিলিটি (দায়িত্বজ্ঞান)।
এই চারটি পিলার বাস্তবায়নই একটি কোম্পানিকে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ করতে পারে, শতাধিক বছর বাঁচিয়ে রেখে অমরত্ব (পারপেচ্যুয়াল সাকসেশন) দিতে পারে।
এদিকে করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডের ৯ নং শর্তে যে সার্টিফিকেট নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে সেটির বাস্তব চিত্র খুবই ভয়ঙ্কর। খবর পাওয়া গেছে, অনেক কোম্পানির ফিন্যন্সশিয়াল অডিট ফার্ম তিনিই অন্য আরেকজনের সিগনেচার নিয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে মাত্র ৫-১০ বড়জোর ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে। অর্থাৎ করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডের প্রকৃত বাস্তবায়ন বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল হয়ে ২০১৯ পর্যন্ত নানান ধাপে এই করপোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইন পরিপালনের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ১৩ বছর সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সামনে আরো আসবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেটি তা হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে ফ্যামিলি গভর্ন্যান্স থেকে বের হতে হবে। এজন্য এই কোড পরিপালনে কোম্পানির পরিচালকদের নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মিত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করার জন্য কমিশন যেভাবে অডিটর প্যানেল তৈরি করে দিয়েছে; অনুরূপভাবে কোম্পানির সেক্রেটারিয়াল অডিটের জন্য আলাদা প্যানেল তৈরি করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।