প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ৩ ব্রোকারেজ হাউসের কনস্যুলেট কাস্টম অ্যাকাউন্ট (সমন্বিত গ্রাহক হিসাব) ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হল- ব্রোকারেজ হাউস কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের অগোচরে তার টাকা তুলে নিয়েছে। ফলে ওই ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা মানে, বিনিয়োগকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলা।
সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে পড়া ৩ ব্রোকারেজ হাউসের মধ্যে রয়েছে- সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ইন্ডিকেট সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেড এবং আল-মুনতাহা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, ব্রোকারেজ হাউস তিনটির মধ্যে সিনহা সিকিউরিটিজের অবস্থা বেশি খারাপ। প্রতিষ্ঠানটিতে সমন্বিত গ্রাহক হিসাব মোটা অংকে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।
সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক থাকার পাশাপাশি ইন্ডিকেট সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেডে মালিকানা দ্বন্দ্ব চলছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, ওই তিন ব্রোকারেজ হাউসের পাশাপাশি আরও প্রায় শতাধিক ব্রোকারেজ হাউস সমস্যায় রয়েছে। এসব হাউস থেকেও গ্রাহকদের অগোচরে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে তার পরিমাণ তুলনামূলক কম।
সম্প্রতি ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শহিদ উল্লাহ আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর চিত্র খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব তথ্য পেয়েছে ডিএসই। গত ২ জুন অনুষ্ঠিত ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ তথ্য উপস্থাপন করা হলে কয়েকজন পরিচালক উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
যোগাযোগ করা হলে ডিএসই’র এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ৩টি ব্রোকারেজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। একটি ব্রোকারেজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে গেলে ওই হাউসের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা বিনিয়োগকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
ওই পরিচালক বলেন, ‘ মনে করেন, আমার ব্রোকারেজ হাউসে ১০ জন বিনিয়োগকারীর ১০ লাখ টাকা আছে। এখান থেকে আমি পাঁচ লাখ টাকা তুলে নিলাম। এভাবে টাকা তুলে নিলে একজন বিনিয়োগকারীর পক্ষে তা জানা অসম্ভব। কারণ, একজন বিনিয়োগকারী হাউসে গেলে তাকে একটা স্টেটমেন্ট দেয়া হয়। তাতে টাকা জমার পরিমাণ এবং শেয়ার কেনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। ব্রোকারেজ হাউস মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্টেটমেন্ট তৈরি করে দিলে বোঝার কোনো উপায় নেই।’
এ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে তার বেনিফিসিয়ারি ওনার অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব)-এর বিপরীতে একটি করে মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করে দিতে হবে। যাতে ওই বিও হিসাবে কোনো লেনদেন হলে গ্রাহকের কাছে অটোমেটিক এসএমএস চলে যায়, তাহলেই বিনিয়োগকারীরা তাদের হিসাবে কোনো লেনদেন হলে তার তথ্য পেয়ে যাবেন।
তিনি আরও বলেন, ব্রোকারেজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবের স্টেটমেন্ট ডিএসই’র কাছে থাকে। কিন্তু কেউ যদি স্টেটমেন্ট ম্যানুপুলেট করে তাহলে ধরা কঠিন। এক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউসের স্টেটমেন্টের সঙ্গে ব্যাংকের স্টেটমেন্ট মিলিয়ে দেখতে হবে। দুই স্টেটমেন্ট যদি না মিলে তাহলে বুঝতে হবে ঘাপলা আছে।
ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, শতাধিক ব্রোকারেজ হাউসের মধ্যে সমন্বয় আছে। এসব ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীদের অগোচরে টাকা উঠিয়ে নেয়ার ঘটনাও আছে। তবে তিনটি হাউসের অবস্থা বেশি খারাপ। ডিএসই থেকে সব ব্রোকারেজ হাউসের প্রকৃত চিত্র খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ইন্ডিকেট সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মামুন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাউসে বিনিয়োগকারীদের টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা নাই। কেউ যদি চান, অন্য হাউসে চলে যেতে পারেন। আমাদের হাউস থেকে টাকা তুলে নিলে, সেটা নিতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার একজন পার্টনার আছে, সে ঠিকমতো কো-অপারেট করছে না। এ কারণে আমাদের বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ফাইল করা হয়নি। লাইসেন্সও নবায়ন হয়নি। লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় ডিএসই বলছে, আমরা লেনদেন করতে পারব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার যে পার্টনার সাব্বির সাহেব, উনি হয়তো চাচ্ছেন হাউসটা বন্ধ হয়ে যাক। তাহলে হয়তো উনি আমাকে জিম্মি করতে পারবেন। কারণ, এর আগে উনি কিছু উল্টাপাল্টা কাজ করেছেন। অ্যাকাউন্ট থেকে আমার বেশকিছু টাকা তসরুফ করেছেন।’
আল-মুনতাহা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আকবর কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়নি। আমাদের ব্যাংক হিসাবে এখনও পৌনে পাঁচ কোটি টাকা আছে। ক্লায়েন্টের কিছু মাইনাস হয়েছে, এটা সব জায়গায় আছে। এটার জন্য তো কোনো সমস্যা নাই। আমাদের হাউসে বিনিয়োগকারীদের টাকার কোনো ঝুঁকি নেই। তারা আসছেন, শেয়ার কিনছে, টাকা জমা দিচ্ছেন, টাকা তুলছেন; কোনো সমস্যা তো নেই।’
সিনহা সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির-উর রহমান সিনহার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, এটা সিনহার মোবাইল নম্বর নয়। সিনহা সিকিউরিটিজও নয়।
এদিকে, সিনহা সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির-উর রহমান সিনহার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করে বলা হয়, এটা সিনহার মোবাইল নম্বর নয়। সিনহা সিকিউরিটিজও নয়। তবে নাসির-উর রহমান সিনহার অপর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু কেউ রিসিভ করেননি।
শেয়ারবার্তা / আনিস