বিগত ১৭ মে দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন গঠিত হয়েছে। যে কমিশন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়তে শুরু করেছে। যার অভাব বা সংকটকে পুঁজিবাজারের চলমান মন্দাবস্থার প্রধান কারন বলে একটি পক্ষ মনে করতেন। এছাড়া নতুন কমিশনের কর্মকান্ডে বিনিয়োগকারীরা খুশি। কিন্তু তারপরেও পুঁজিবাজারে কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
বিগত কমিশনের নেতৃত্বাধীন সময়ে সর্বশেষ কার্যদিবস ছিল ২৫ মার্চ। ওইদিন ফ্লোর প্রাইসের মধ্যেই ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৩৪৮ কোটি ১৪ লাখ টাকার। আর ওইদিনের লেনদেন শেষে সূচক দাড়িয়েছিল ৪০০৮ পয়েন্টে। এরপরে কমিশন পরিবর্তনের মাধ্যমে ১ মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু লেনদেন এবং সূচক ওই কমিশনের রেখে যাওয়ার থেকে নিচে অবস্থান করছে। এমনকি নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরে সূচকটি শুধুমাত্র ১ কার্যদিবস বিগত কমিশনের রেখে যাওয়ার থেকে উপরে উঠেছিল। তবে ব্লকে একটি কোম্পানির মূল মালিকানার পরিবর্তনে কারনে ও ফ্লোর প্রাইসের থেকে ব্লকে নিচে লেনদেন করার সুযোগ দেওয়ায়, ২-৪দিন অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছিল।
ড. এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের পরিবর্তনে পুঁজিবাজারে বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে একটি মহল মনে করত। ওই কমিশনের পরিবর্তনের প্রথম কার্যদিবসেই সূচক ৩০০-৪০০ পয়েন্ট এবং এক সপ্তাহের মধ্যে সূচক ১ হাজার পয়েন্ট বাড়বে এমন ধারনা অনেকেই করতেন। এমনকি তার পদত্যাগের গুজবের দিন সূচক বাড়লে, ওই বৃদ্ধি পদত্যাগের গুজবেই হয়েছে বলে অনেকে মনে করতেন। কিন্তু বাস্তবে ওই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে বিদায়ের পরে ১ মাসের বেশি লেনদেনেও বাজারে কোন উন্নতি হয়নি। বরং লেনদেন এবং মূল্যসূচকে পতন হয়েছে। এই উন্নতি হওয়ার পেছনে নতুন কমিশনের কোনো ভূমিকা রয়েছে, নাকি অন্যকোন দূর্বলতা রয়েছে?
বিগত কমিশন করোনাভাইরাসের মধ্যে বিদায় নিয়েছে এবং এখনো তা বিদ্যমান রয়েছে। ফলে বিগত কমিশনের শেষটা ও নতুন কমিশনের শুরুর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। এই প্রায় সমঅবস্থানে থাকার পরেও বাজারে কমিশন পরিবর্তনের কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এছাড়া নতুন কমিশনও বাজারের উন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের কথায় বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্তও হচ্ছেন। তাদের সর্বশেষ কমিশন মিটিংয়ের দেড় কোটি টাকার জরিমানা নিয়েও অনেকে উচ্ছাস। তারপরেও কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
বিগত কমিশনের সময়ে সুশাসনের অভাব ও দূর্বল কোম্পানির আইপিওর কারনে বাজারে মন্দাবস্থা বলে অনেকে দাবি করতেন। তবে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের আইপিওর মান খারাপ ছিল না। তালিকাভুক্তিতে ভারত এগিয়ে থাকলেও শেয়ারের বাজার দরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে গত প্রায় সাড়ে ৩ বছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৬৩ শতাংশ শেয়ার ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। সেখানে বাংলাদেশে এই হার ৩১ শতাংশ। তারপরেও ভারতের শেয়ারবাজার করোনাভাইরাসের মধ্যে ঘুরে দাড়িঁয়েছে। কিন্তু আমাদের এখনো বিক্রির চাপ রয়েছে। একইসঙ্গে রয়েছে ক্রেতা সংকট।
আগের কমিশনের এক সভায় ৫ কোটি টাকা জরিমানা করার নজিড় আছে। শাহজিবাজার পাওয়ারের শেয়ার কেলেঙ্কারীতে ২০১৫ সালের ২ জুন অনুষ্ঠিত ৫৪৬তম সভায় ৯ প্রতিষ্ঠান ও ৮ ব্যক্তিকে ওই জরিমানা করা হয়েছিল। যে কমিশনের পুরোটা সময় নিজস্ব অর্থায়নে চলেছে বিএসইসি। জরিমানার কারনেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তবে জরিমানার স্বল্পতা নিয়ে সমালোচনা ছিল এবং তা বর্হিবিশ্বের তুলনায় কম ছিল-এটা বাস্তব। তবে নতুন কমিশনের দেড় কোটি টাকার জরিমানা নিয়ে অনেকে উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। এই জরিমানার মাধ্যমে নতুন কমিশন সুশাসনের ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে অনেকে দাবি করলেও বাজারে উত্থান ঘটেনি। এছাড়া নতুন কমিশন ওয়ালটনের মতো জায়ান্ট কোম্পানির আইপিও দেওয়া সত্ত্বেও উত্থান হয়নি। তাহলে সমস্যা কোথায়?
বাজারের চলমান মন্দাবস্থার পেছনে তারল্য সংকটকে প্রধান কারন হিসেবে মনে করছেন একটি পক্ষ। তাদের মতে, পুঁজিবাজারে অনেকদিন ধরে তারল্য সংকট রয়েছে। যা করোনাভাইরাসে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় আরও প্রকট আকার ধারন করেছে। এই তারল্য সংকট কাটিয়ে তুলতে বিগত কমিশনের নেতৃত্বে প্রত্যেকটি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকার সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে ব্যাংকগুলো ওই অর্থ এখনো বিনিয়োগে আনেনি। তাই শিবলী রুবাইয়াতের কমিশনও ব্যাংকগুলোর ওই অর্থ বিনিয়োগে আনার চেষ্টা করছেন।
তারল্য সংকটের পাশাপাশি গত কয়েকবছর ধরে ব্যাংক খাতের চলমান নৈরাজ্য পুঁজিবাজারে বড় নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এ খাতের শেয়ার যেদিকে মুভমেন্ট করে, পুঁজিবাজারও সেদিকে মুভমেন্ট করে এমন কথা প্রচলিত আছে। তবে নৈরাজ্যের কারনে এ খাতের শেয়ার মুভমেন্ট করেছে তলানির দিকে। গত ২ বছরে এ খাতটির শেয়ার দর কমেছে ৩৯ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার আগেই ২ বছরের ব্যবধানে গত ২ মার্চ এ খাতের শেয়ার দর এমন পতন হয়েছে।
পুঁজিবাজারে মন্দা কাটিয়ে উঠতে না পারার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাব ও আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা হ্রাসও অন্যতম কারন হিসেবে কাজ করছে। এখনও দেশে প্রকৃত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুবই কম। একসময় (২০০৯-১০ সালে) পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা নিয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠে ব্যাংকগুলো এখন অনেক দূরে। ওইসময় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগসীমার কয়েকগুণ পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। যা পুঁজিবাজারকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলে। অথচ এখন সেই বিনিয়োগসীমা ৪ ভাগের ১ ভাগে নামিয়ে আনার পরেও এবং শেয়ার দর তলানিতে থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে না।
অন্যদিকে পুঁজিবাজারের দুঃসময়ে সহযোগিতা করা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও নিজস্ব পোর্টফোলিওকে পঁচা শেয়ারের ভাগাড়ে পরিণত করা প্রতিষ্ঠানটি নিজেই দূরবস্থায়। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে সাপোর্ট দেওয়াতো দূরের কথা, আইসিবির নিজস্ব দুরবস্থারোধে দরকার আরেকটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি ঋণ আদায় করতে না পারলেও নিজস্ব পোর্টফোলিওর শেয়ার বিক্রি করে নিজের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আরও মন্দায় পড়েছে।
পুঁজিবাজারে দুঃসময়ে ক্রয় বাড়ানো দরকার হলেও আইসিবির পক্ষে তা এখন সম্ভব হয় না। যতবারই প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্নভাবে অর্থ সহযোগিতা দেওয়া হোক না কেনো, কোনবারই তার প্রতিফলন পুঁজিবাজারে দেখা যায় না। যে প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের স্বার্থ উদ্ধারে পঁচা শেয়ারের পার্কিংয়ের দায়িত্ব পালন করে বলে অভিযোগ আছে। যে কারনে গত ১৬ জানুয়ারির প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে গৃহিত ৬ পদক্ষেপের মধ্যে আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।