করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা যত বেশি জানছি, তত বেশি উপলব্ধি হয়েছে যে, এটি কেবল শ্বাসকষ্টের সংক্রমণ নয়। ভাইরাসটি মস্তিষ্ক এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রসহ অনেকগুলো প্রধান অঙ্গ সিস্টেমকে ধ্বংস করতে পারে। এমনটাই প্রকাশ করেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
চেলসি অ্যালিয়োনা নামের একজন তিনমাস ধরে জ্বর, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় ভুগছিলেন, যা অনেকটা ডিমেনশিয়ার সঙ্গে মিলে যায়। মার্চের ৯ তারিখে তিনি অসম্ভব মাথাব্যথা অনুভব করেন এবং এরপরে স্বাদ এবং গন্ধের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি করোনাভাইরাস পরীক্ষা করান এবং পজেটিভ রেজাল্ট আসে। তবে তার লক্ষণগুলো বেশিরভাগই অপরিচিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল।
চীনের উহান শহরে কোভিড -১৯ এর জন্য হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে খিঁচুনি এবং চেতনালোপ এবং স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যার লক্ষণ রয়েছে। এই মাসের শুরু দিকে, ফরাসি গবেষকরা জানিয়েছেন যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আট শতাংশ রোগী আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন। তারা স্নায়বিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এবং যখন তাদের হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে তখন তেত্রিশ শতাংশ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেলম্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সাইকিয়াট্রিস্ট এবং এপিডেমিওলজিস্ট ডঃ ম্যাডি হর্নিগের মতে, স্নায়ুজনিত সমস্যাগুলো ব্যক্তিজীবনেও নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকবে এবং প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধা তৈরি করবে, এমন সম্ভাবনা বেশি দেখা যাচ্ছে।
সংক্রমণ দীর্ঘকাল ধরে স্নায়বিক রোগে জড়িয়ে পড়েছে। সিফিলিস এবং এইচ.আই.ভি. ডিমেনশিয়াকে প্ররোচিত করতে পারে। সঠিক চিকিৎসা না পেলে নার্ভ ব্যথা, মুখের পক্ষাঘাত এবং মেরুদণ্ডের প্রদাহ হতে পারে। সার্স আক্রান্ত এক ব্যক্তির স্মৃতিলোপ পেয়েছিল এবং পরে তিনি কোমায় চলে যান। সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার মস্তিষ্কের টিস্যুতে ভাইরাস রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়।
স্নায়ু বিশেষজ্ঞরা এমনটা বলছেন না যে, প্রত্যেক করোনা আক্রান্ত রোগী মস্তিষ্কের ক্ষতির শিকার হবেন। তবে ভাইরাসটি মস্তিস্ককে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে যা এখনও পুরোপুরি বোঝা যায় নি।
এটি কীভাবে হয়? গবেষণায় জানা যায় যে, করোনাভাইরাস সরাসরি নিউরাল কোষগুলোকে সংক্রামিত করতে পারে। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবিয়াল প্যাথোজেনেসিস এবং ইমিউনোলজির অধ্যাপক ডক্টর জেফ্রি সিরিলো বলেন, ভাইরাসটি সম্ভবত কোষের ভিতরে প্রতিলিপি তৈরি করে এবং তাদের কাজকে প্রভাবিত করে। এই ভাইরাল আক্রমণের শিকার রোগীদের মস্তিষ্কের সমস্যা ক্রমাগত থাকতে পারে বা সম্ভবত তাদের নিয়মিত খিঁচুনি হতে পারে। লস অ্যাঞ্জেলেসে গত এপ্রিলে মাথাব্যথা, খিঁচুনি এবং হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত চল্লিশ বছর বয়সী এক নারীর সেরিব্রোস্পাইনাল তরল থেকে করোনাভাইরাসের আরএনএ পাওয়া গিয়েছিল।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা সৃষ্ট ব্যাপক প্রদাহের মাধ্যমে করোনভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। ডক্টর ফোটুহি বলেছেন, ইনফ্লামেশন মস্তিষ্কের জন্য খারাপ এবং আমরা জানি এটি একটি বড় বিষয়। আলঝাইমার গবেষণার অন্যতম প্রধান তত্ত্ব হলো, ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ এই রোগকে বাড়িয়ে দেয়।
মস্তিষ্কের প্রদাহ রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত এই সমস্যা ঘটে থাকে। এই জমাটবাধা রক্ত মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং এটি স্ট্রোকের দিকেও যেতে পারে। চীন এবং ইতালি থেকে প্রাপ্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে স্ট্রোকের শিকার প্রায় পাঁচ শতাংশ। তবে নিউইয়র্ক হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি কম ছিল, মাত্র এক শতাংশ।
এসব উদ্বেগের প্রেক্ষিতে নিউরোলজিস্টরা যুক্তি দেখান যে, কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে তাদের স্নায়ুতন্ত্র কীভাবে পুনরুদ্ধার হয় বা কী হয় না তা বোঝার জন্য গবেষণা করা গুরুত্বপূর্ণ। ডাঃ সিরিলো, ডাঃ কোরালনিক এবং ডাঃ হর্নিগ এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, তবে আরও গবেষণা করা জরুরি, তারা জানান।