দীর্ঘ দিন ধরেই বাজারে এই সংকট চলছে। আস্থা আর তারল্য সংকটে ধুঁকছে দেশের পুঁজিবাজার। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির আতঙ্ক। দর পতন ঠেকাতে আরোপ করা ফ্লোর প্রাইস নামের ব্যবস্থার কারণে লেনদেন নেমে এসেছে তলানীতে। চলতি মাসের একাধিক দিন গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম লেনদেন হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)।
তবে শেয়ারের বর্তমান মূল্যস্তর বা সূচকের অবস্থানই বাজার নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কারণ বেশ কিছু কোম্পানির মূল্যস্তর তার মৌল ভিত্তি বা তার সম্ভাব্য রিটার্নের তুলনায় অনেক কম। তাই দীর্ঘ মেয়াদে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে ভাল মুনাফার সম্ভাবনা আছে। আর এই সম্ভাবনাই আগামী দিনে নতুন বিনিয়োগকারী টেনে আনতে পারে বাজারে। কারণ পুঁজির ধর্মই হচ্ছে, যেখানে রিটার্ন বা মুনাফার সম্ভাবনা বেশি,পুঁজি সেখানেই ছুটে যায়।
বাজার কতটা সম্ভাবনাময় তার ইঙ্গিত দিচ্ছে সিএপিই বা শিলার মূল্য-আয় অনুপাত। এই অনুপাত গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে। ব্রোকারহাউজ রয়্যাল ক্যাপিটালের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে এই অনুপাত ১৭। দশ বছর আগে শিলার পিই রেশিও ছিল ৫২ দশমিক ৯।এই রেশিও ২০১০ সালে সর্বোচ্চ ১০৮ দশমিক ৩ হয়েছিল। পরের তিন বছর এটি টানা কমে ৩১ দশমিক ৪ এ নেমে আসে। তবে পরের বছর তথা ২০১৪ সালে এটি একটু বেড়ে ৩২ দশমিক ৫ হয়।কিন্তু তার পর থেকেই সেটি টানা কমে চলেছে।
উল্লেখ,সিএপিই মূল্য-আয় অনুপাতের ইংরেজি প্রকাশ হচ্ছে-CAPE Price to Earning Ratio।এর পূর্ণ অভিব্যক্তি-Cyclically Adjusted Price to Earnings Ratio। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট শিলার (Robert Shiller)এর মাধ্যমে এটি জনপ্রিয়তা পায়। তাই এটি শিলার পিই রেশিও (Shiller PE Ratio)নামে বেশি পরিচিত।
শিলার পিই রেশিও একটি দেশের পুঁজিবাজারে চিত্রকে দীর্ঘ মেয়াদে অনুধাবনের সুযোগ করে দেয়।কারণ যে কোনো দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারে স্বল্প মেয়াদে বড় ধরনের উত্থান পতন হয়ে থাকতে পারে। তাই স্বল্প সময়ের সময়সীমা দিয়ে বাজার পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করলে প্রকৃত প্রবণতা জানা বেশ কঠিন। যেমন ২০১০, ১১ ও ১২ সালের নিরিখে ২০২০,১৯ ও ১৮ সালের প্রবণতা দেখতে চাইলে তা প্রকৃত অবস্থা দেখাতে সমর্থ হবে না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির (এমনকি বাজারের বাইরের কোম্পানিরও)পারফরম্যান্স অনেকাংশে নির্ভর করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। সাধারণভাবে কোনো একটি দেশের অর্থনীতি যদি চাঙা থাকে তাহলে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বা ব্যয় করার মতো সামর্থ্য অনেক বেড়ে যায়।তাতে কোম্পানির মুনাফার সুযোগও বেড়ে যায়। আবার যখন অর্থনীতিতে মন্তা নেমে আসে বা গতি মন্থর হয়ে পড়ে তখন ভোক্তাদের আয় কমে যায়, একইভাবে কমে তাদের ব্যয় করার সক্ষমতা। ফলে কোম্পানির মুনাফার সুযোগও কমে যায়।
শিলার পিই রেশিও’র ক্ষেত্রে বৃহত্তর সময়সীমা (Time frame)বিবেচনায় নেওয়া হয় বলে অর্থনীতির সুসময়-দুঃসময় উভয়ের তথ্যই তাতে অন্তর্ভূক্ত হয়।
শিলার পিই রেশিও যে কোনো শেয়ারের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য,তেমনই এটি সূচকের ক্ষেত্রেও ব্যবহারযোগ্য। শেয়ারের ক্ষেত্রে তার আগের ১০ বছরের (সাধারণত ৭ থেকে ১০ বছর ব্যবহৃত হয়) শেয়ার প্রতি আয়ের (ইপিএস) সমষ্টি থেকে একই সময়ের মূল্যস্ফীতির সমষ্টি বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অংশ দিয়ে শেয়ারের মূল্যকে ভাগ করতে হয়।
অন্যদিকে সূচকের ক্ষেত্রে এই রেশিও ব্যবহার করতে হলে শেয়ারের বাজার মূল্যের জায়গায় বাজারমূলধন এবং শেয়ারের ইপিএস এর জায়গায় তালিকাভুক্ত সব কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা সমষ্টি ব্যবহার করতে হয়। আর ইপিএসের এই সমষ্টি থেকে ১০ বছরের মূল্যস্ফীতির সমষ্টি বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ দিয়ে বাজারমূলধনকে ভাগ করতে হয়।
বাংলাদেশের বাজার নিয়ে কী বলছে শিলার পিই রেশিও?
শিলার পিই রেশিও আমাদের বাজার নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো ইঙ্গিত দিচ্ছে।এই রেশিও গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে।এমনকি এটি গত ১০ বছরের অনুপাতের গড়ের (৪৩ দশমিক ৫)অর্ধেকের চেয়েও কম।এর অর্থ বর্তমান বাজার গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে অবমূল্যায়িত।এই এই পর্যায়ে বিনিয়োগের ঝুঁকিও কম, উল্টোদিকে রিটার্ন বা মুনাফার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
(বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের শিলার পিই রেশিওসহ অন্যান্য টুলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিজের বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই করা উচিত। আর দাম কিংবা পিই রেশিও যত কমই হোক মন্দ কোম্পানি থেকে দূরে থাকা-ই শ্রেয়। সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন,তার দায় সংশ্লিষ্ট বিনিযোগকারী। অর্থসূচকের উপর কোনো দায় প্রযোজ্য হবে না)