রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) মুদ্রাবাজারে মেয়াদি আমানত (এফডিআর) রেখে ফেঁসে যাচ্ছে। চলতি বছরের জুন শেষে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আইসিবির এফডিআর ছিল ৬৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া ১৮ ব্যাংকে এফডিআর ছিল প্রায় ৩৭০ কোটি টাকা। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করায় এই অর্থের সিংহভাগই তুলতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটি।
জানা গেছে, আইসিবি যে ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর করেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্তত ছয়টি খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। আইসিবির এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত আইসিবি তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করছে। ফলে মুদ্রাবাজার থেকে নেওয়া তহবিল আবার মুদ্রাবাজারেই ফিরে আসছে। এতে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা তলবি ঋণ নিয়েছিল আইসিবি। তিন মাস মেয়াদি ওই ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ওই ঋণ বারবার নবায়ন করতে হচ্ছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে ঋণটি নবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া দুই হাজার কোটি টাকা বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে নেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিতে পেরেছে আইসিবি। অথচ আইসিবি তার তহবিলের পুরোটা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার কোটি টাকার বেশি এফডিআর হিসেবে গচ্ছিত রেখেছে।
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে এর আগে এফডিআর রেখে আটকে গিয়েছিল আইসিবি। ওই ব্যাংকে আইসিবির এফডিআর ছিল ৬৯ কোটি টাকা। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে ব্যাংকটি পুনর্গঠন করা হয় ২০০৭ সালে। পুনর্গঠন স্কিমের আওতায় ওই ৬৯ কোটি টাকা মেয়াদি আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করা হয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ার ধারণ করায় মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তর করা হলেও এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক’। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ওই এফডিআরের বিপরীতে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে আইসিবির শেয়ারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৬৮ হাজার, যার মূল্য ধরা হয়েছে ১৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং ব্যাংকে নগদ টাকা হিসেবে রয়েছে ২২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত জুন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ৩০৮ কোটি ৬৯ লাখ শেয়ারে ১২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল আইসিবি’র। ওই সময়ে আইসিবি’র ধারণকৃত শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১১ হাজার ৬০৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত শেয়ারে এক হাজার ১৭ কোটি টাকা লোকসানে রয়েছে আইসিবি।
এদিকে বিনিয়োগযোগ্য পর্যাপ্ত তহবিল না থাকার কথা বলে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরও এক হাজার কোটি টাকার তহবিল সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেছে আইসিবি। পাশাপাশি পাঁচটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কাছে ২০০ কোটি টাকা করে আরও এক হাজার কোটি টাকা তহবিল সহযোগিতার আবেদন করেছে আইসিবি।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও আইসিবি’র চাহিদা অনুযায়ী তহবিল জোগান দেয়নি। আইসিবি সূত্রে জানা গেছে, আইসিবির কাছে তহবিল বিনিয়োগের বিষয়ে কী কী পরিকল্পনা রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আইসিবিও কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ওই জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় সম্প্রতি আইসিবি তহবিল জোগানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, আইসিবির সাবেক এমডি কাজী সানাউল হক দায়িত্বে থাকাকালে আইসিবি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর রাখতে শুরু করে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আইসিবি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা এফডিআর রেখেছিল। সেখান থেকে বর্তমানে এফডিআরের পরিমাণ কমে এক হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
জানতে চাইলে আইসিবির সাবেক এমডি মো. ফায়েকুজ্জামান বলেন, সাধারণত আইসিবি’র মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগের কথা নয়, তবে তহবিল উদ্বৃত্ত থাকলে সেটা চলতি আমানত হিসেবে রাখা যায়। আমার সময়ে এমন কোনো আমানত ছিল না। ২০১৭ সালে প্রতিকূল বাজার পরিস্থিতিতে একসঙ্গে অনেক বেশি শেয়ার বিক্রি করেছিল আইসিবি। ওই সময় তহবিলটা যাতে অলস পড়ে না থাকে সেজন্য হয়তো এফডিআরের প্রসঙ্গটা আসে। তবে সেটাও সাময়িক সময়ের জন্য।’
আইসিবি’র বর্তমান এমডি মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘পুজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আমাদের টাকার প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের কাছে তহবিল চেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু তথ্য চেয়েছিল, সেগুলোও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা তহবিল দেওয়ার বিষয়ে কোনো কিছু জানায়নি।’ বারবার যোগাযোগ করেও তহবিল না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে আইসিবি’র এমডি বলেন, ‘ওই তহবিলের কথা তো ভুলেই গেছি।’
পুজিবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘আমার জানামতে, আইসিবি বর্তমানে তহবিল সংকট রয়েছে। অথচ তাদের এক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর করে রাখাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের খতিয়ে দেখা উচিৎ।’
শেয়ারবার্তা / মিলন