করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির পরামর্শের পর কর্মকর্তাদের বেতন কমাতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংকের পাশাপাশি সিটি ব্যাংক ও এবি ব্যাংকেই ইতোমধ্যে বেতন কমিয়ে দিয়েছে।
আরও কয়েকটি ব্যাংক বেতন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
সিটি ব্যাংক তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৬ শতাংশ বেতন-ভাতা কমিয়েছে। বেতন কমানোর এই সিদ্ধান্ত চলতি মাসের ১ জুন থেকেই কার্যকর হবে। বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এক্সিম ব্যাংক বেতন কমিয়েছে ১৫ শতাংশ। এ ব্যাংকেও ১ জুন থেকেই কার্যকর হয়েছে। বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এবি ব্যাংক মে ও জুন মাসের বেতন ৫ শতাংশ কমিয়েছে। আগামী মাসগুলোতে বেতন কমবে কি না, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিন ব্যাংকে বেতন কমানোর খবর ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাংক পাড়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
সঙ্কটকালে কর্মীদের বেতন কমানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যেমন অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তেমনি বিএবির তৎপরতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
বেতন কমানোর চিঠিতে ক্ষুব্ধ ব্যাংক কর্মকর্তারা
সিটি ব্যাংক
গত বৃহস্পতিবার সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন ব্যাংকের অর্ধশত জ্যেষ্ঠ কর্মীকে ডেকে বেতন কমানোর ঘোষণা দেন।
সিটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, চলমান পরিস্থিতিতে লোকসান ঠেকাতে কোনো কর্মীকে ছাঁটাই না করে বেতন-ভাতা কিছু কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিটি ব্যাংকে ৪ হাজার ৫০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা প্রদানে ব্যাংকের বছরে খরচ হয় ৫৪০ কোটি টাকার মতো। চলতি বছরের জুন মাস থেকে বেতন-ভাতা ১৬ শতাংশ কমানো হলে বছরে খরচ কমবে ১০০ কোটি টাকার মতো।
কর্মকর্তাদের বেতনের কমে যাওয়া ১৬ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ৬ শতাংশ।
ব্যাংকটি আগামী বছর (২০২১ সালে) পারফরমেন্স বোনাস ও ইনক্রিমেন্টও দেবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সিটি ব্যাংক ২০১৯ সালে ৮৪০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০২০ সালে মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫০ কোটি টাকা।
গত ৫ মাসে (জানয়ারি-মে) ২৩৫ কোটি টাকার মুনাফা হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে কর পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান লোকসানে গেলে বেতন কমানোর প্রশ্ন আসতে পারে। আমাদের ব্যাংক তো লাভে আছে। তাহলে কেন বেতন কমবে?
“কর্মীদের স্বার্থ বিরোধী এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যাংকের জন্য ক্ষতি ছাড়া ভালো বয়ে আনে না। বেতন-ভাতা কমানোর ফলে কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে; গ্রাহক মানসম্মত সেবা পাবে না।”
এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য পরিচালনা পর্ষদকে অনুরোধ জানান ওই কর্মকর্তা।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন মঙ্গলবার বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পরিচালনা পর্ষদ এ সিদ্ধান্ত নিতে ‘বাধ্য হয়েছে’।
“গত তিন মাস ধরে আমাদের সব ধরনের ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকরা বিল পরিশোধ করছেন না। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ করা এবং করোনাভাইরাসের কারণে মুনাফা ২০২০ সালে অর্ধেকে নেমে আসবে।”
২০১৯ সালে ব্যাংকটির মুনাফা হয়েছিল ৮৪০ কোটি টাকা। এবার সেই মুনাফা চার থেকে সাড়ে চারশ কোটি টাকায় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা মাসরুরের।
“আমরা মুনাফা করার জন্য নয়, লোকসান না করে টিকে থাকার জন্য ১৬ শতাংশ বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পরিস্থিতিতে আমরা কোনো কর্মীকে ছাঁটাই করতে চাই না।”
যাদের বেতন ৩০ হাজার টাকার বেশি, কেবল তাদের বেতন কমানো হয়েছে বলে জানান মাসরুর।
তিনি বলেন, “এক লাখ টাকা বেতনধারী কর্মকর্তার ১৫ হাজার টাকা বেতন কমলেও তিনি চলতে পারবেন। কিন্তু যদি চাকরি চলে যায় তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
“সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমাদের কর্মীরা ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আগের সুযোগ-সুবিধা ফিরে পাবে।”
এক্সিম ব্যাংক
এক্সিম ব্যাংকে ১৫ শতাংশ বেতন কমানো ১ জুন থেকেই কার্যকর হয়েছে। বহাল থাকবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, তাদের পরিচালনা পর্ষদের এই সিদ্ধান্ত কর্মকর্তারাও ‘মেনে নিয়েছেন’।
তিনি জানান, যে সব কর্মকর্তার বেত ৪০ হাজার টাকার বেশি, কেবল তাদের বেতনই কমানো হয়েছে।
বেতন কমে গেলে কর্মকর্তাদের সংসার চালাতে সমস্যা হবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে নজরুল মজুমদার বলেন, “যারা কম বেতন পান, তাদেরটা তো কমাতে বলিনি। সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সঙ্কটের সময় তো সবাইকেই ছাড় দিতে হবে।”
বেসরকারি ব্যাংক-উদ্যোক্তা মালিকদের সংগঠন বিএবি রোববার একটি চিঠি দিয়ে সব ব্যাংককে আগামী দেড় বছর ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ শতাংশ কমাতে বলেছিল।
এবিবির চেয়ারম্যান পদে এক যুগ ধরে রয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। ১৯৯৩ সালে বিএবির যাত্রা শুরু হয়। নজরুল মজুমদার চেয়ারম্যান পদে আসেন ২০০৮ সালে।
তিনি এক্সিম ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান। এ ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে।
এবি ব্যাংক
কর্মকর্তাদের বেতন কমানোর বিষয় নিয়ে কথা বলতে এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজালের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।
তবে ব্যাংকটির অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত মে ও চলতি জুন মাসের বেতন ৫ শতাংশ করে কম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ।
আগামী দিনগুলোতে বেতন কম দেওয়া অব্যাহত থাকবে কি না, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।