শেয়ারবাজার খুবই জটিল, স্পর্শকাতর ও টেকনিক্যাল জায়গা। এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা পদ্ধতি মুনাফার নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ অনেক ধরনের ফ্যাক্টর কাজ করে এখানে। আর এসব ফ্যাক্টর নিয়মিত পরিবর্তনশীল। তাই এই বাজারে বিনিয়োগের সময় অনেক সতর্ক ও যত্নবান থাকতে হয়; নইলে বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকি থাকে।
কিছু নিয়মকানুন অনুসরন করলে এখানে ভালো করার সুযোগ থাকে। লোকসানের আশংকা কম থাকে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ১০টি নিয়ম এখানে তুলে ধরা হল। তবে নিজ নিজ বাস্তবতা ও বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে নিয়মগুলো অনুসরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভালো।
০১. বিনিয়োগযোগ্য তহবিলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করুনঃ
আপনার হাতে বিনিয়োগ করার মত যে অর্থ আছে, তাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করুন। প্রতিটি ভাগ ভিন্ন ভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করুন। ধরুন-আপনার হাতে ৩০ লাখ টাকা আছে। এটিকে আপনি তিনটি সমান ভাগে ভাগ করতে পারেন। এ থেকে ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে, ১০ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে এবং বাকী ১০ লাখ টাকা জমি বা অন্য কোনো সম্পদ কেনায় কাজে লাগাতে পারেন।
এভাবে বিভিন্ন খাতে ভাগ করে বিনিয়োগ করা হলে ঝুঁকি কমে আসে। একটি খাতে কোনো কারণে মন্দা দেখা দিলে বা লোকসানে পড়লে অন্য খাতের মুনাফা দিয়ে তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। তাই ভুলেও আপনার পুরো অর্থ শেয়ারবাজার বা একটি খাতে বিনিয়োগ করবেন না।
০২. সক্রিয় শেয়ারে বিনিয়োগ করুনঃ
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয়ে নজর রাখা ভাল। এর মধ্যে দেখতে হবে কোম্পানির মৌলভিত্তি। কোম্পানিটি কী পণ্য উৎপাদন করে, উৎপাদিত কোথায় বিক্রি করে, গত কয়েক বছরের বিক্রি, মুনাফা ও লভ্যাংশের রেকর্ড।
এসবের পাশাপাশি একটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। দেখতে হবে আপনি যে শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছেন তা সক্রিয় শেয়ার কি-না। অর্থাৎ বাজারে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ওই শেয়ারটির কেনা-বেচা হয় কি-না। কারণ আপনাকে বিনিয়োগ করার সময় ওই বিনিয়োগ সহজে প্রত্যাহার করার কথাও ভাবতে হবে। যে শেয়ার নিয়মিত পর্যাপ্ত সংখ্যায় কেনা-বেচা হয় না, সেটিতে বিনিয়োগ করা হলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। শেয়ার বিক্রির সময় ক্রেতা পাওয়া যায় না। অথবা অনেক কম দামে বিক্রির অফার দিতে হয়। এতে হয় বিনিয়োগ আটকে যায়, নয়তো লোকসান দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হয়।
০৩. বিনিয়োগের আগে পরিকল্পনা জরুরীঃ
যে কোনো শেয়ার কেনার আগে একটি পরিকল্পনা থাকা ভালো। আপনি কত শতাংশ মুনাফা আশা করেন কিংবা কত শতাংশ লোকসান হলে আপনি ওই শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে আসবেন তা আগে থেকে ভেবে নেওয়া ভাল।
ধরা যাক, আপনি একটি শেয়ারে ১০ শতাংশ মুনাফা করার কথা ভেবে বিনিয়োগ করেছেন। শেয়ারটির মূল্য উর্ধমুখী ধারায় থাকলে আপনি হয়ত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। কিন্তু দাম বাড়ছে দেখে কখনো লোভে পড়ে যাবে না। গুজবে কান দেবেন না। আরও বাড়বে এমন আশায় বসে না থেকে শেয়ারটি বিক্রি করে দেওয়াই হবে সবচেয়ে ভাল কাজ। এ সময় বিক্রি না করলে মুনাফার পরিবর্তে উল্টো লোকসানে পড়তে হতে পারে।
০৪. অতিমাত্রায় লেনদেন নয়ঃ
খুব বেশী লেনদেন করা ভাল বিষয় নয়। লেনদেন করতে হবে হিসেব করে, পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। কোনো শেয়ার বিক্রি করার পর এর টাকা দিয়ে ওই দিনই শেয়ার কেনার জন্য অস্থির হয়ে উঠার কোনো মানে নেই। বরং একটু অপেক্ষা করে পরিকল্পনাটি সাজান। ভাল করে পর্যালোচনা করে দেখুন, কোনো শেয়ারের মূল্যস্তর বিনিয়োগ অনুকূল অবস্থায় আছে কি না। যৌক্তিক মূল্যে শেয়ার না কিনতে পারলে মুনাফা করার সুযোগ থাকে কম।
৫. নির্বাচিত শেয়ারে বিনিয়োগ করুনঃ
আমাদের বাজারে প্রায় পৌনে তিনশ কোম্পানি তালিকাভুক্ত আছে। এখান থেকে ৫-১০টি কোম্পানি বেছে নিয়ে সেগুলোতে বিনিয়োগ করা ভাল। খুব বেশী সংখ্যক কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হলে আপনার পক্ষে সবগুলো শেয়ারের খোঁজখবর রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। আর মনোযোগের অভাবে আপনি হয়তো কোনো শেয়ার থেকেই কাঙ্খিত মুনাফা নাও পেতে পারেন। এমনকি লোকসানে পড়ার আশংকাও থাকে যথেষ্ট।
০৬. শেয়ারটি সম্পর্কে জেনে নিন আগে
যে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন, সেটি সম্পর্কে ভালভাবে জেনে নেওয়া উচিত। বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতদের কথায় অন্ধভাবে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল। অনেক সময় শোনা যায়, ওই শেয়ারটির দাম কয়েকদিনের মধ্যে ২০ শতাংশ বেড়ে যাবে। তমুকটির দাম ৩০ শতাংশ কমে যাবে।
এসব গুজবে কান না দেওয়াই ভাল। বরং এমন কোনো তথ্য কানে আসলে এর যৌক্তিকতা কী তা পর্যালোচনা করে দেখুন। কোম্পানির কোনো অপ্রকাশিত তথ্য আছে কী-না, সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায় কোনো পরিবর্তন ঘটছে কী-না, এক্সটার্নাল কোনো ফ্যাক্টর আছে কী-না সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করুন।
০৭. প্রতিদিনই মুনাফার স্বপ্ন নয়ঃ
শেয়ারবাজারে কখনও কখনও কিছু সময় প্রতিদিনই আপনার মুনাফা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে প্রতিদিনই মুনাফা হবে এমনটি ধরে নেওয়া উচিত নয়। এমন আশায় বিনিয়োগ করা হবে বোকামি। অতিমাত্রার আশাবাদের কারণে আপনার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত হতে পারে ভুল।
০৮. মুনাফা প্রত্যাহার করতে শিখুনঃ
কোনো শেয়ারে মুনাফা হলে, আরও মুনাফার আশায় অপেক্ষা না করে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া ভাল। এতে খাতাকলমে থাকা মুনাফা আপনার ঘরে (অ্যাকাউন্টে) আসবে। মনে রাখবেন, গরু গোয়ালে না থেকে কেতাবে থাকলে কোনো লাভ নেই।
সামগ্রিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও মুনাফা প্রত্যাহার করার অভ্যাস করতে হবে। মুনাফার পুরো অর্থ পুনঃবিনিয়োগ না করে এর একটি অংশ প্রত্যাহার করে নিন। সেটি অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করুন। লাভজনক খাত পাওয়া না গেলে অন্তত ব্যাংকে মেয়াদী আমানত হিসাবে জমা রাখুন। তাতে আপনার ঝুঁকি অনেক কমে আসবে।
০৯. মন্দ সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকুনঃ
শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন নিয়মিত বিষয়। আপনি হয়ত চাঙ্গা বাজারে বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু মুনাফা নেওয়ার আগেই ওই বাজারের গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে পারে। একইভাবে একটি শেয়ারের উর্ধমুখী ধারা দেখে আপনি হঠাৎ বিনিয়োগ করে বসেছেন, কিন্তু শেয়ার ম্যাচিউরড হওয়ার আগেই শেয়ারটির দাম কমে যেতে পারে। তাই এমন মন্দ সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১০. গুজবের মধ্যে তথ্য খুঁজুনঃ
বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির ভাল-মন্দ নিয়ে নানা ধরনের গুজব ভেসে বেড়ায়। সেগুলোর কোনো কোনোটির মধ্যে সত্যতার কিছু ছাপ থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু অন্ধভাবে কোনো শোনা কথা কান দেবেন না। বড়জোর যেসব গুজব শোনা গেছে, সেগুলো সম্পর্ক অনুসন্ধান করে দেখুন কোনোটির সত্যতা আছে কী-না।