প্রসপেক্টাসে বিভিন্ন ইস্যুতে অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে ব্যবসায় নিম্নমুখী এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স। এছাড়া কোম্পানিটিতে আইনের ব্যত্যয়ও রয়েছে।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এখন কোম্পানিগুলো ইস্যু ম্যানেজারদের সহযোগিতায় বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করছে। কোম্পানিতে কিছু না থাকলেও তারা সুন্দর করে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। এমন কোম্পানির আইপিও অনুমোদনে বিএসইসির সতর্ক হওয়া দরকার।
প্রসপেক্টাসে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়ের বিস্তারিত তথ্যে মরিয়ম আক্তার ২০১২ সালে প্রথম এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কিনেছেন বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ৪৯ পৃষ্টায় তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। লতিফুল বারির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। কিন্তু ২০১২ সালে প্রথম শেয়ার কিনে ২০০০ সালে গঠিত কোম্পানির উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব না।
বিএসইসির কর্পোরেট গভর্ণেন্স কোড অনুযায়ি, এক-পঞ্চমাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে হবে। অর্থাৎ ৫জন পরিচালকের ১জন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকবে। এছাড়া ৬ জনে গেলেই বা ভগ্নাংশ সংখ্যাটিকে আরেকজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের জন্য বিবেচনায় নিতে হবে। তবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সে এ নিয়ম পরিপালন করা হয়নি। কোম্পানিটিতে ২ জন স্বতন্ত্র পরিচালকসহ মোট ১৩ জন পরিচালক রয়েছেন। এক্ষেত্রে কমপক্ষে আরও ১জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।
প্রসপেক্টাসের ২০০ পৃষ্টায়, আইসিবি ইসলামীক ব্যাংকের ৪০০ শেয়ারে বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে। যার ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাজার মূল্য ছিল ১৯২০ টাকা। কিন্তু এই শেয়ারে বিনিয়োগে ব্যয় দেখানো হয়েছে শূন্য।
২০০ পৃষ্টাতেই ইউনাইটেড লিজিং কোম্পানির নামে ১৮৫৯৩৩০ টাকা বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে। যার বাজার দর ৭৪৭৮৮৫ টাকা। কিন্তু শেয়ারবাজারে এই নামে লিজিং কোম্পানি নেই।
আরও পড়ুন……….
টানা ৫ বছর ধরে ব্যবসায় নিম্নমুখী এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স
তারল্য সংকটের শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিয়ে এফডিআর করবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স
২০৫ পৃষ্টা অনুযায়ি, কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনাদি আগের বছর থেকে কমে ২০১৮ সালে ৯ কোটি ২৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। যার পরিমাণ আগের বছর ছিল ৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সময়ের ব্যবধানে যেকোন প্রতিষ্ঠানের বেতনাদি বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক হলেও এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সে কমেছে।
প্রসপেক্টাস অনুযায়ি, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম পাওয়ার যোগ্য হলেও শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে শেয়ারবাজারে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি আর্নিংস বেজড ভ্যালু পার শেয়ার পদ্ধতিতে শেয়ারপ্রতি ২০ টাকা পাওয়ার যোগ্য বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ২০ বছরের ব্যবসায় কোম্পানিটির উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা পরিশ্রম করে এই দরের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। তবে কোম্পানিটি অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যু করবে। কিন্তু একটি কোম্পানির সমস্যা থাকলেই শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে আসতে চায় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
প্রসপেক্টাস অনুযায়ি, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের ২০১৮ সাল শেষে কর সঞ্চিতির পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। প্রতিবছরই সঞ্চিতিজনিত দায় ও অগ্রিম কর প্রদান বাড়ছে। কিন্তু কর সম্বয় হচ্ছে না।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের ২৬ কোটি টাকা উত্তোলনে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের বা আইপিও পূর্ববর্তী শেয়ারহোল্ডারদের ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার লোকসান বা মালিকানা কমে আসবে। বর্তমানে কোম্পানিটিতে আইপিও পূর্ববর্তী শেয়ারহোল্ডারদের ১৮.৭২ টাকা হারে ৭৩ কোটি ২২ লাখ টাকার সম্পদের মালিকানা রয়েছে। তবে শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে শেয়ারবাজারে আসার অনুমোদন পাওয়ায়, কোম্পানিটির আইপিও পরবর্তীতে শেয়ারপ্রতি সম্পদ ৩.৪৯ টাকা কমে ১৫.২৩ টাকায় নেমে আসবে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের বা আইপিও পূর্ববর্তীদের শেয়ারপ্রতি ৩.৪৯ টাকা হারে মোট ১৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লোকসান হবে।
হিসাববিদদের মতে, বিএএস-৩৬ অনুযায়ি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ইমপেয়ারম্যান্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো তা না করে সম্পদ ও মুনাফা বেশি দেখায়। এ ক্ষেত্রে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সও এর ব্যতিক্রম না। কোম্পানিটিও সম্পদ এবং মুনাফা বেশি দেখিয়ে আসছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) করপোরেট গভর্নেন্স ফাইন্যান্সিয়াল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেকোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ইমপেয়ারমেন্ট লস হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কোম্পানিগুলো গতানুগতিকভাবে তা না করে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ি, নিট আয়ের ৫ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন করতে হয়। তবে কোম্পানিটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ফান্ড গঠন করেনি।
কোম্পানিটির নিট সম্পদ ব্যবহারের তুলনায় ২০১৮ সালে মুনাফার হার বা রিটার্ন অন ইক্যুইটি (আরওই) মাত্র ৫.৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার সম্পদ ব্যবহার করে বছরে ৫.৯৯ টাকা মুনাফা করেছে। তবে এই মুনাফার হার ২০১৪ সালে ছিল ১৩.৪৬ শতাংশ। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনসহ অন্যান্য কারনে নিট সম্পদ নিয়মিত বাড়লেও মুনাফা না বাড়ায় এমনটি হয়েছে। এমন ধারাবাহিকতায় আইপিওতে উত্তোলনের পরে মুনাফার হার আরও কমবে।
২০০০ সালের ৩০ মার্চ পাবলিক কোম্পানি হিসাবে গঠিত এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয় একই বছরের ১৮ মে। কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ২৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা সংগ্রহ করবে।
এ বিষয়ে জানতে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল আওয়ালের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া ম্যাসেজ দিয়েও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। আর কোম্পানি সচিব লিয়াকত আলী খান বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) অবগতি ছাড়া কোন মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই। আর এমডি অফিসে না আসায় অবগত করা যাচ্ছে না।