করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে সরকারের সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় দুই মাস ধরে দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রয়োজন হলেও কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে টাকা তোলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতিতে ঈদের আগেরই শেয়ারবাজারে লেনদেন চলু করার দাবি উঠেছে স্টেকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, শেয়ারবাজারে লেনদেন না হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি আটকে রয়েছে। ফলে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেয়া হলেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা কোনো ধরনের প্রণোদনা পাচ্ছেন না। তাই ঈদের আগে সীমিত আকারে হলেও শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করা উচিত। এতে কষ্টে থাকা বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে কিছু টাকা হলেও তুলতে পারবেন।
এদিকে স্টেকহোল্ডারদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে সরকার ব্যাংক, গার্মেন্টস শপিংমল সীমিত আকারে খোলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ব্যাংকের মতো শেয়ারবাজারও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া শেয়ারবাজারে লেনদেন করার জন্য খুব বেশি জনবলের প্রয়োজন নেই। আবার শেয়ার বিক্রি বা কেনার জন্য বিনিয়োগকারীদের ব্রোকারেজ হাউজে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই সীমিত আকারে হলেও বিনয়োগকারীদের স্বার্থে ঈদের আগে শেয়ারবাজার লেনদেন চালু করা উচিত।
স্টেকহোল্ডার ও বিনিয়োগকারী উভয় পক্ষের দাবি, শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এতে কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নামতে পারবে না। সুতরাং ঈদের আগে লেনদেন চালু করলে ক্রেতা সংকটে বাজার পতনের মধ্যে চলে যাবে, এমন যে ধারণা রয়েছে তা সঠিক না। যেহেতু কোনো কোম্পানির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইসের নিচে যাওয়ার সুযোগ নেই, সুতরাং দরপতনেরও সুযোগ নেই।
এদিকে সাধারণ ছুটির মধ্যে গত ১০ মে থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের কাছে সম্মতি চেয়ে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে লেনদেন চালুর জন্য কিছু নীতিমালা শিথিল করার দাবি জানানো হয়। তবে কিছু নীতিমালা শিথিল করার জন্য বিএসইসির কমিশন সভার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোরাম সংকটে কমিশন সভা করতে ব্যর্থ হয় বিএসইসি। এর প্রেক্ষিতে বিএসইসি তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মতামত নেয়ার জন্য পাঠিয়েছে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও ১০ মে থেকে লেনদেন চালু করতে পারেনি ডিএসই। এ পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটির মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এই প্রজ্ঞাপনে জরুরি সেবার বিষয়ে যে কয়টি খাত রয়েছে তার মধ্যে পুঁজিবাজার রাখা হয়নি। সুতরাং বিশেষ সুযোগ না দেয়া হলে ঈদের আগের পুঁজিবাজারে আর লেনদেন করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, লকডাউনের কারণে পৃথিবীর কোন দেশের শেয়ারবাজার বন্ধ আছে? সব দেশের শেয়ারবাজার চালু। জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে আমাদের দেশে ব্যাংক, গার্মেন্টস খুলে দেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারও ব্যাংকের মতো একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাহলে ব্যাংক খুললে পুঁজিবাজার কেন বন্ধ থাকবে? পুঁজিবাজারে ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী। এই বিনিয়োগকারীদের জীবন ও জীবিকা আছে। তাদের টাকার প্রয়োজন আছে। তারা কেন তাদের টাকা তোলার অধিকার পাবেন না?
তিনি বলেন, সামনে ঈদ। ঈদের আগে পুঁজিবাজার না খুললে একটি ভুল বার্তা যাবে। বিনিয়োগকারীরা হতাশ হবেন। বাইরের বিনিয়োগকারীরা হতাশ হবেন। আমরা যে বৈশিক পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত, সেখানে আমাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকবে না। ‘এখন প্রশ্ন হলো ঈদের আগে পুঁজিবাজার চালু হলে হয় তো লেনদেন কম হবে। কিন্তু লেনদেন কম হওয়ার কারণে তো বিনিয়োগকারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা যায় না। যে বিনিয়োগকারীর টাকা দরকার তিনি শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নেবেন। এটা তার অধিকার। তাকে তার এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক না। তাছাড়া সবাই তো শেয়ার বিক্রি করতে যাবেন না। যার টাকার দরকার তিনি শেয়ার বিক্রি করবেন। বিপরীতে অনেকে শেয়ার কিনতে যাবেন’, বলেন ডিএসইর এই পরিচালক।
রকিবুর রহমান আরও বলেন, শেয়ারবাজারে লেনদেন হবে ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে। একটি শাখা চালাতে ব্যাংকের মতো স্টাফ লাগবে না। দুই-তিন জন হলেই যথেষ্ট। বিনিয়োগকারীদেরও ব্রোকারেজ হাউসে আসতে হবে না। তারা মোবাইলের মাধ্যমে, ই-মেইলের মাধ্যমে, অ্যাপসের মাধ্যমে লেনদেন করবেন। প্রত্যেকটি ব্রোকারেজ হউসের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। বিনিয়োগকারীরা তাদের পছন্দ মতো ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে পারবেন।
ডিএসইর এই পরিচালক বলেন, ঈদের আগে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু করা হলে ধস নামবে এমন গুঞ্জন ছড়ানো হচ্ছে। এটা একদম ঠিক না। কারণ শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এটা পুঁজিবাজারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করার কারণে কোনো শেয়ার নির্ধারিত দামের নিচে নামার সুযোগ নেই। সুতরাং ধস নামারও কোনো কারণ নেই।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, দীর্ঘদিন পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় আমরা বেশ কষ্টে আছে। শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলবো তার কোনো সুযোগ নেই। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও কেউ বলতে পারে না। প্রায় দুই মাস হয়ে যাচ্ছে ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছি। সামনে ঈদ। এই ঈদের খরচ জোগাড় করার নিয়ে এক ধরনের হতাশার মধ্যে রয়েছি। পুঁজিবাজারে লেনদেন হলে কিছু শেয়ার বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে পারতাম।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর থেকেই বিনিয়োগকারীরা বাজারে লোকসান দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে আমাদের ক্রান্তিকাল যাচ্ছে। আমার অনেক ভাইয়ের ঘরে খাবার নেই। পরিবার নিয়ে তারা অসহায় জীবনযাপন করছেন। শেয়ারবাজার বন্ধ থাকায় শেয়ারও বিক্রি করতে পারছে না। আমাদের দাবি ঈদের আগে শেয়ারবাজারে চালু করা হোক। এতে কম দামে শেয়ার বিক্রি করে হলেও আমাদের বিনিয়োগকারীরা কিছু টাকা জোগাড় করতে পারবেন। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়ারও দাবি জানাচ্ছি।
শেয়ারবার্তা / আনিস