যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যারা ব্যাংকের টাকা লুট করেছে, জনগণের টাকা লুট করেছে তাদের বিরুদ্ধে দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে এবং তাদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি সরকারিভাবে একটি অ্যাসেট মানেজমেন্ট কোম্পানি করে সেই কোম্পানির মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা পরে বাজারে বিক্রি করে টাকা আদায়ের যে পরিকল্পনা করেছেন, আমি মনে করি তা সফল হবার নয়; বরং এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে যাবে। তাতে এই সুযোগে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করার আরও সুযোগ পেয়ে যাবে।
তার চেয়ে বড় কথা হল এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যে জমি বন্ধক রেখেছে- মনে করেন যার বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা, কিন্তু সেটা তারা দেখিয়েছে ২শ থেকে ৩শ কোটি টাকা। এর সঙ্গে তারা যে পার্সোনাল বা কর্পোরেট গ্যারান্টি দিয়েছে তার কোন মূল্য নাই। তাদের বন্ধকী জমি বিক্রি করতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখবেন এই জমিগুলো আরও অনেক জায়গায় বন্ধক দেয়া, আছে।
অতএব মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহান পার্লামেন্টে আপনি বলেছেন -এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের যোগসাজশে এবং তাদের অনুগত ব্যাংকের এমডি এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় তারা গ্রাহকের টাকা নিজের নামে, বেনামে বা আত্মীয় জনের নামে আত্মসাৎ করে বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুরে তারা বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছে। ব্যাংক পরিচালকরা যারা ইচ্ছাকৃতভাবে টাকা ফেরত দিচ্ছে না, তাদের ব্যাংকের পরিচালক থাকার অধিকার নাই। এদের খুঁজে বের করতে হবে।
ব্যাংকের প্রকৃত মালিক হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার, তাদের স্বার্থ দেখতে হবে
ব্যাংকের প্রকৃত মালিক হলো হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার, তাদের স্বার্থ আপনাকে দেখতে হবে। ব্যাংক পরিচালকদের সর্বোচ্চ শেয়ার সংখ্যা হল মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ারের মালিক। এদেরকে ছেড়ে দেয়া যায় না। এজন্য অর্থমন্ত্রীকে কঠোর হতে হবে। আপনি অত্যান্ত অভিজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ স্নেহভাজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে সফলতার সঙ্গে ঋণ আদায় করেছে।
দেউলিয়া আইন কঠোর প্রয়োগ বলতে বুঝায়, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণের টাকা লুটপাট করেছে, তাদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। যেমন চীনে যারা দেউলিয়া আইনের আওতায় পড়েছে তাদের গাড়ি বাড়ি থাকবে না, তাদের সন্তানেরা দামি স্কুলে পড়ালেখা করতে পারবে না, প্লেনে চড়তে পারবে না,এমনকি বুলেট ট্রেনেও চড়তে পারবে না।
এই আইনের কঠোর প্রয়োগের ফলে তিন বছরের মধ্যে ৮০ শতাংশ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন সরকারও দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায়ে সক্ষম হয়েছে।
অপরদিকে ভারতের অর্থমন্ত্রী নিরমলা সিতারাম গত ১ বছর আগে একই পদ্ধতিতে দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং শুরু করেছেন। তাতে তিনি বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন এবং প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার উপর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ কেউই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে চায় না।
দায়িত্ব নেয়ার পর ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপিঋণ পুনঃতফসিল করে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো চালুর সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে মাত্র অল্প সংখ্যক খেলাপি ডাউন পেমেন্ট দিয়ে, তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। মজার বিষয় হলো, তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রি-অর্গানাইজড করে চালু করার জন্য ব্যাংকের কাছে টাকা চেয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল- যে সব প্রতিষ্ঠান বছরের-পর-বছর বন্ধ আছে, তারা যে ধরনের ব্যবসা করতো, বর্তমানে তাদের পক্ষে নতুন ব্যবসা চালু করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব?
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কোনো পরিকল্পনা, অভিজ্ঞতা ও সততা ছিল না। ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে, নিজস্ব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সহযোগিতায় এবং বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকগুলোর সরকার মনোনীত পরিচালক এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়, তারা ব্যাংক এবং জনগণের অর্থ লুটপাট করেছে। এরা জেলে গেলেও টাকা ফেরত দেয়ার ইচ্ছা, একেবারেই নেই। অতএব এদের বিরুদ্ধে বাস্তবসম্মত আইন প্রয়োগ করে টাকা আদায়ের অনুরোধ করছি।
অপরদিকে যেসব শিল্পপতিদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আছে, ওই কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে এবং সেই কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেছেন, ওই প্রতিষ্ঠানের শিল্প উদ্যোক্তারা উচ্চ সুদের কারণে অথবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে যদি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে, তাদের প্রতি সদয় হতে হবে।
কীভাবে তাদের ইন্ডাস্ট্রি চালিয়ে রাখা যায়, সে ব্যাপারে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না হয়ে যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক চাকরি হারানো এবং বিনিয়োগকারীদের যে ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।
লেখক: মো. রকিবুর রহমান
পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)