করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীসহ সব ধরনের মানুষের জন্য প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা দেখতে তিন স্তরে তদারকি করা হবে। প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নেতৃত্বে আলাদা আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করা হবে।
প্যাকেজে কোনোভাবেই যাতে অনিয়ম না হয় এ বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করবে এ সেলগুলো। আর এ দুটি সেলের কার্যক্রম তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল। মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যৌথভাবে এ তদারকির কাজ করবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে তিন স্তরে তদারকি করা হবে। মনিটরিংয়ের মূল কাজ হবে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি প্যাকেজের অর্থ কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যাদের জন্য প্যাকেজ করা হয়েছে তারা সহায়তা পাচ্ছে কিনা, কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তদারকির অংশ হিসেবে ঘোষিত এসব প্যাকেজ নিয়ে সঠিকভাবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ এবং বাস্তবায়নে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা নিরসনে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইওদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে আগামী বৃহস্পতিবার (৭ মে) এ ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংকসহ সব রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিরা ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মু. শুকুর আলী বলেন, ‘সভায় রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত থাকবেন। এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে তাদের কী কর্মপরিকল্পনা এসব নিয়ে আলোচনা করব। প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নে মূলত মনিটরিং করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। মন্ত্রণালয় থেকে জাস্ট ওভারসি করা হবে।’
যুগ্ম সচিব বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিক যেহেতু সরকার সেহেতু তাদের নিয়ে আমরা চিন্তা করব যে, আমরা ওভার অল মিনিস্ট্রির পক্ষ থেকে কীভাবে মনিটর করা যায় বা এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা এসব বিষয়েই মূলত ডিসকাশন করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক যে মনিটরিং কমিটি করেছে তারাই মনিটর করবে। এছাড়া প্রত্যেকটি ব্যাংকে আলাদা কমিটি থাকবে তারাও মনিটর করবে। যেহেতু এটা সরকারের প্যাকেজ তাই অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে সার্বিক বিষয়টা দেখভাল করবে। এছাড়া এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোনো বাধা থাকলেও আমরা সেগুলো দূর করার চেষ্টা করব।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রণোদনার অধিকাংশ ঋণে সুদহার ধরা হয়েছে। তার অর্ধেক পরিশোধ করবে গ্রাহক ও বাকি অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করবে সরকার। তবে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য মাত্র দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ দেয়া হচ্ছে। প্রণোদনার ঋণ ব্যাংক-গ্রাহক ভিত্তিতে হলেও গ্রাহককে প্রণোদনার ঋণ পেতে আবেদন করতে হবে। আবেদনের একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
এদিকে সরকার যেসব প্রণোদনা দিয়েছে তার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি সার-সংক্ষেপ তৈরি করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সার-সংক্ষেপে প্রণোদনার অর্থ কীভাবে ব্যয় হবে তার বর্ণনা থাকছে। কোন কোন খাত এতে উপকৃত হবে তাও বলা হয়েছে। যা শিগগির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর জন্য তৈরি করা সার-সংক্ষেপে প্রণোদনা বাবদ সরকারের ভর্তুকি ও সুদ ব্যয় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সবশেষে এতে সরকারি ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অ্যাকশন প্ল্যানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং মন্ত্রণালয়গুলো একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। অ্যাকশন প্ল্যানটি ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সবাই।
করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি ফিরিয়ে আনতে এই প্রণোদনা ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে পূর্বে যারা ঋণ খেলাপি ছিল তারা কোনোভাবেই এ প্যাকেজ থেকে সুবিধা পাবে না। এটিও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
যদিও এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের অধিকাংশ টাকার সংস্থানই হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এরপরও প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদ ভুর্তকি বাবদ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সংস্থান বাজেট থেকে হবে। এছাড়াও গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতের জন্য অতিরিক্ত ২৫০ কোটি টাকাসহ বেশ কিছু টাকা বাজেট থেকে সংস্থান করা হবে।
শেয়ারবারর্তা / মিলন