করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের দ্রুত ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একই সঙ্গে এসব খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসম্ভব সহজ পন্থা অনুসরণ করতে হবে। কোনোক্রমেই জটিলতার বেড়াজালে ফেলে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা যাবে না।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এতে তাদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণের গ্রাহক নির্বাচন ও বিতরণ প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, সে বিষয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ নিজ প্রধান কার্যালয় থেকে তদারকির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী ৫টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে একটি ছিল কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল।
এর আলোকে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার কাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি নেই বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার সার্কুলারের মাধ্যমে দ্রুত ও সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করার নির্দেশনা দিয়েছে।
এ তহবিলের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেবে ১০ হাজার কোটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে ১০ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে উদ্যোক্তারা দেবেন ৪ শতাংশ এবং সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে ৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশে চলছে লকডাউন। ওই সময়ে পণ্যের উৎপাদন যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি বাধাগ্রস্ত হয়েছে পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা। কিন্তু উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হচ্ছে।
কিন্তু তাদের হাতে নতুন অর্থের জোগান নেই। ফলে অনেক উদ্যোক্তাই চলতি মূলধন সংকটে পড়তে পারেন। এ কারণে এসব খাতে দ্রুত উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে তাদের চলতি মূলধনের জোগানে উদ্যোগ নেয়া হয়। সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের হাতে ঋণের অর্থ পৌঁছে দিতে। এতে তারা দ্রুত ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
সার্কুলারে বলা হয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে জামানত গ্রহণ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ জটিলতা নিরসন করতে ঋণের জামানত হিসেবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও গ্রুপভিত্তিক গ্যারান্টি নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর জারি করা অপর এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বলতে ঋণগ্রহীতার গ্যারান্টির পাশাপাশি ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পক্ষের কাছে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গ্যারান্টির দিতে হবে। সামাজিক গ্যারান্টি বলতে কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অঙ্গীকারনামাকে বোঝাবে।
আর গ্রুপ গ্যারান্টি বলতে ঋণগ্রহীতাদের একটি গ্রুপকে বোঝাবে। ঋণের জন্য আবেদন করার পর থেকে ১০ দিনের মধ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ মঞ্জুরের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে গ্রাহককে লিখিতভাবে জানাতে হবে। এতে মাঝারি শিল্পের গ্যারান্টি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জানান, মাঝারি শিল্পের গ্যারান্টিতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয় না। তাদের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন রয়েছে। ফলে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
তিনি বলেন, সমস্যা হয় যাদের পর্যাপ্ত ব্যাংকিং লেনদেন নেই। ব্যাংক তাদের ঋণ দিতে ভরসা পায় না। ফলে জামানত নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ জটিলতা নিরসনে ওইসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সার্কুলারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণগ্রহীতা নির্বাচন, ঋণ বিতরণ, তদারকি ও আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সদস্য সংশ্লিষ্ট চেম্বার বা অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে। আগে যেসব উদ্যোক্তার ব্যাংক ঋণ নেই, কিন্তু করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদেরও নতুন করে ঋণ দিতে বলা হয়েছে।
উদ্যোক্তারা যাতে দ্রুত ও সহজে ঋণ পায় সে জন্য ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি শাখায় আবশ্যিকভাবে একটি আলাদা হেল্প ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। সহজে দৃষ্টিগোচর হয় এমন স্থানে প্যাকেজের তথ্যাদি সহজভাবে উল্লেখ করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেই উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, এসব ঋণ বিতরণ কার্যক্রম যথাযথভাবে তদারকি করার জন্য প্রধান কার্যালয়ে একটি বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। এ টিম শাখা পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাবে। ঋণ বিতরণে যাতে কোনো দীর্ঘসূত্রতা বা অনিয়ম না হয় সেদিকেও নজর রাখবে এ টিম।
সার্কুলারে বলা হয়, ২০১৯ সালে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের চেয়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে হবে। লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে কটেজ, মাইক্রো ও কুটির শিল্প খাতে দিতে হবে ৭০ শতাংশ।
এর মধ্যে উৎপাদন খাতে ৫০ শতাংশ, সেবা খাতে ৩০ এবং ব্যবসা খাতে ২০ শতাংশ। মোট লক্ষ্যমাত্রার বাকি ৩০ শতাংশ দিতে হবে মাঝারি শিল্প খাতে। মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৫ শতাংশ দিতে হবে নারী উদ্যোক্তাদের এবং ১৫ শতাংশ বিতরণ করতে হবে গ্রামে।
শেয়ারবার্তা / মিলন