প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রণোদনা প্যাকেজে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ কমেছে। প্যাকেজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়া না জানালেও এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা করা প্যাকেজ তাদের মন ভালো করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা দূর হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এক কথায় এই প্যাকেজ যতটা সুন্দর হওয়া দরকার ছিল, ঠিক ততটাই সুন্দর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত এই প্যাকেজ আমাদের হতাশা দূর করেছে। এটা অত্যন্ত সমযোপযোগী প্যাকেজ। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ীরা যে আতঙ্কে ছিলেন, সেটা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। কারণ, একেবারে ছোট, মাঝারি, বড় সব ব্যবসায়ী বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষজনও এই প্যাকেজ থেকে সুবিধা পাবেন।
তিনি বলেন, ‘ব্যবসা টিকে থাকার জন্য এই প্যাকেজ বড় ভূমিকা রাখবে। তবে, এই প্যাকেজ বাস্তবায়নে যাতে কোনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ এপ্রিল গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। যা জিডিপির ২.৫২ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সংকট উত্তরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোসহ চারটি কার্যক্রম নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজে আমাদের সবারই মন ভালো। এই প্যাকেজে ব্যবসায়ীদের মনে শুধু আশার সঞ্চার হয়েছে এমন নয়, ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোরও সাহস জুগিয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি, রফতানিমুখী শিল্প ও বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তা দূর করতে সহায়ক হবে এই প্যাকেজ।’
বিকেএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই প্যাকেজ এক কথায় যথার্থ উদ্যোগ। এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
‘তবে যাদের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তারা যাতে সুফল পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ কারণে বলবো প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নটাই আসল। বিগত বিভিন্ন উদ্যোগের মতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেন এই প্যাকেজগুলো বাধাগ্রস্ত না হয়’, যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজ ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বিজিএমইএ পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বড় উদ্যোক্তাদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্যাকেজে রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও লাভবান হবে। কারণ, এই খারাপ সময়ও ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে। তিনি বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তৃণমূলে টাকা পৌঁছানো এবং হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকা কেজি চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি ভালো উদ্যোগ। প্যাকেজে মুদ্রা সরবরাহের বিষয়ে যেটা বলা আছে, তাতে মানুষের হাতে টাকা থাকবে। তবে এই প্যাকেজ বাস্তবায়নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই মুহূর্তে ঋণগুলো দেওয়া প্রয়োজন। ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে তাদের কর্মচারীদের বেতন প্রদান এবং চলতি মূলধনের জন্য এই ঋণ দ্রুত গতিতে তাদের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।’ এই উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান বলেন, এ মুহূর্তে দেশের দু’টি পুঁজিবাজারই বন্ধ আছে, প্রণোদনা প্যাকেজটি বাস্তবায়ন হলে পুঁজিবাজার খোলার পর বাজারে এই প্যাকেজের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তবে প্যাকেজ সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মতো আশাবাদী নন অন্য শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা খুশি। তবে আমরা ফার্নিচার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সুবিধা পাবো কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেনি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনও গাইডলাইন এখনও হয়নি। তবে যেটা বলা হচ্ছে, প্যাকেজ থেকে ব্যাংক তার পছন্দের গ্রাহকদেরই সুবিধা দেবে, ফলে ব্যাংকের সঙ্গে ভালো খাতির না থাকলে ক্ষতিগ্রস্তরাও হয়তো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।’
বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান এস কে সৈয়দ আলী বলেন, সময়োপযোগী ও চমৎকার প্যাকেজ ঘোষণা করায় আমরা বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগতভাবে বাজার হারাচ্ছে দেশের পাট শিল্প। যেটুকু বাকি ছিল, এই করোনার কারণে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, কাঁচা পাট রফতানিকারকদের বর্তমান বিপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের প্যাকেজ থেকে আমরাও সুবিধা পাবো বলে আশা রাখি।
তিনি বলেন, আমরা কাঁচা পাট রফতানি করি। একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এই ব্যবসা। নানা কারণে পাঁচবারেরও বেশি পাট রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমরা ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে পড়ি।
চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশি চা সংসদের সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজ খুবই ভালো এবং যুগোপযোগী। বিশেষ করে শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি প্যাকেজকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে। প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ঋণের বিপরীতে সুদের ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে একটা সুবিধা পাবো। এছাড়া প্যাকেজ থেকে চা শিল্পের জন্য আমরা আরও সুবিধা কীভাবে নিতে পারবো, তা নিয়ে কাজ করছি।
তিনি উল্লেখ করেন, এমনিতেই চা শিল্পের পরিস্থিতি ভালো না। এই বছর চায়ের উৎপাদন কমে গেছে। গত বছরের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কম উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া নিলাম বন্ধ রয়েছে। চা বিক্রিও হচ্ছে না। মালিকরা চা বিক্রি করতে না পারায় টাকাও পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, তবে কৃষি ব্যাংক আমাদের ঋণ দিচ্ছে। আমরা আবেদন করবো, যাতে সব বাগান মালিককে তারা ঋণ দেয়। কারণ, আমরা বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি।
চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা কীভাবে ঋণ পাবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্যাকেজ খুবই চমৎকার। তবে আমরা চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা কীভাবে ঋণ পাবো, তা এখনও বুঝতে পারছি না। তিনি উল্লেখ করেন, এই প্যাকেজের সুবিধা কারা পাবেন, কাদের দেওয়া হবে, বিষয়টি আমাদের কাছে এখনও পরিষ্কার না।
তিনি আরও বলেন, চামড়া খাতে বৃহৎ শিল্প আছে, চারশ’ কোটি টাকারও বেশি অনেকের বিনিয়োগ আছে। আবার ছোট, মাঝারি উদ্যোগও আছে। তবে মনে হচ্ছে, ব্যাংকের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ভালো, কেবল তারাই সুবিধা পাবেন। বাকিদের হয়তো খুব বেশি উপকার হবে না। কারণ, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই জামানত দিতে পারবেন না।
উল্লেখ্য, প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৯ শতাংশ সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা আছে। এর মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিক ৪.৫ শতাংশ ভর্তুকি এবং সরকার ৪.৫ শতাংশ ভতুর্কি দেবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ঋণের হার ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের ৫ শতাংশ সুদ সরকার দেবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) বর্তমান আকার ৩.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এর সুদের হার কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এই ঋণের সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
এছাড়া রবিবার ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেয়ারবার্তা / হামিদ